প্রতি বছরের আগস্টের প্রথম রবিবার বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় ‘বিশ্ব বন্ধু দিবস’। মানব জীবনের অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ এই সম্পর্ককে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী তৈরি হয়েছে অসংখ্য গান, নাটক ও সিনেমা। তেমনি ঢাকাই সিনেমাতেও নির্মিত হয়েছে বেশকিছু কালজয়ী সিনেমা। এমনকি সিনেমার সাথে দেশের দর্শক উপহার পেয়েছে হৃদয়ে আলোড়ন তোলা বেশ কিছু বন্ধুত্বের গানও। বিশ্ব বন্ধু দিবসে আজ বন্ধুত্ব নিয়ে ঢালিউডের আটটি জনপ্রিয় সিনেমার নাম জেনে নেয়া যাক।
দোস্ত দুশমন (১৯৭৭)
বলিউডের অন্যতম ধ্রুপদী ব্যবসাসফল ছবি ‘শোলে’র (১৯৭৫) বাংলা ভার্সন বানিয়েছিলেন নির্মাতা দেওয়ান নজরুল। নাম দিয়েছেন দোস্ত দুশমন।‘শোলে’র জয়-ভীরুর আদলে এই ছবিতে আসে জনি ও রাজা। দুই বন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন সোহেল রানা ও ওয়াসিম। দুই বন্ধুর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে ‘দোস্ত আমরা দুজন’ গানটিও জনপ্রিয়তা পায়। গানটি গেয়েছেন খুরশীদ আলম ও ফাহিম। এটি ছিল ওই বছরের অন্যতম ব্যবসাসফল ছবি।
বন্ধু (১৯৭৮)
রাজ্জাক ও উজ্জলের বন্ধুত্বের ছবিটি নির্মাণ করেন নির্মাতা দিলীপ বিশ্বাস। জমিদারপুত্রের চরিত্রে অভিনয় করেন উজ্জল, দাসির ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেন নায়করাজ রাজ্জাক। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের চিত্রনাট্যে ছবিতে দেখানো হয় শ্রেণিবৈষম্যের বাঁধা পেরিয়ে বন্ধুত্বের জয়ের গল্প। সিনেমায় সুবীর নন্দীর কণ্ঠে গাওয়া ‘বন্ধু তোর বারাত নিয়া আমি যাব’ গানটি একটি কালজয়ী গানে পরিণত হয়।
জিঞ্জির (১৯৭৯)
‘বন্ধু’ ছবির সাফল্যের পর নির্মাতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার-দিলীপ বিশ্বাস জুটি পরের বছরই নির্মান করেন তিন বন্ধুর গল্প। সেসময় প্রথমবারের মতো একই ছবিতে অভিনয় করেন রাজ্জাক, সোহেল রানা ও আলমগীর। বছরের সবচেয়ে ব্যবসাসফল এই ছবির ‘সুমন রাজন মোহন, বন্ধু আমরা তিনজন’ গানটিও শ্রোতাপ্রিয় হয়।
ভাই বন্ধু (১৯৮৬)
বন্ধুত্ব নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন ও জাফর ইকবালের সিনেমা ভাই বন্ধু বেশ জনপ্রিয় সিনেমা।‘আমার ভাইয়ের মতো বন্ধুকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। সেই বন্ধুকে আমি ফেরত চাই’ ছবির শেষের দিকে বন্ধু ইলিয়াস কাঞ্চনকে উদ্দেশ্য করে জাফর ইকবালের মুখের এই সংলাপ দর্শককে কাঁদিয়েছে। ইলিয়াস কাঞ্চন ও জাফর ইকবাল দুজনের ক্যারিয়ারের অন্যতম জনপ্রিয় ছবিটির পরিচালক ছিলেন দারাশিকো। এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া বিখ্যাত ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’ এ ছবিরই গান।
বন্ধু আমার (১৯৯২)
বন্ধুত্ব নিয়ে আরেক কালজয়ী সিনেমা বন্ধু আমার।এই সিনেমার মাধ্যমে দর্শক উপহার পান কালজয়ী গান। গানটি হল “একটাই কথা আছে বাংলাতে, মুখ আর বুক বলে একসাথে, সে হলো বন্ধু, বন্ধু আমার, বন্ধু আমার”। ভারতের বাপ্পী লাহিড়ী ও মুন্না আজিজের গাওয়া গানটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বন্ধুত্ব নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় গান। সময়ের সঙ্গে এই গানের জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে। নানা সাংঘাতের মধ্যে বহু বছর পর দুই বন্ধুর মিলনকে কেন্দ্র করে ছবির গল্প। নায়ক জাফর ইকবালের মৃত্যুর পর মুক্তি পায় আওকাত হোসেনের এই ছবিটি। ফারুক ও জাফর ইকবালের বন্ধুত্বের এই গল্প দর্শক মনকে বেশ নাড়া দেয়।
দীপু নাম্বার টু (১৯৯৬)
মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলামের এই ছবি দর্শক-সমালোচকদের খুব প্রিয়। মা-বাবার বিচ্ছেদের পর বাবার সঙ্গে থাকে দীপু। বাবার খেয়ালি মন আর চাকরির জন্য প্রায়ই নতুন স্কুলে ভর্তি হতে হয় দীপুকে। নতুন স্কুলে দীপুর পরিচয় হয় তারিকের, মারামারি আর অকারণ ঝগড়া করা যার স্বভাব। এক ঘটনাচক্রে দীপু আর তারিক হয়ে ওঠে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই জুটি পরাজিত করে দেশদ্রোহী এক ডাকাতদলকে। দীপু চরিত্রে অভিনয় করে সেরা শিশুশিল্পীর জাতীয় পুরস্কার পায় অরুণ সাহা।
ব্যাচেলর (২০০৪)
ঢাকা শহরের একদল অবিবাহিত বন্ধুর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার টানাপড়েনের গল্প নিয়ে ছবিটি। আনিসুল হকের রচনায় নির্মাণ করেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা আলাদা গল্প। দিন শেষে নিজেদের সব মান-অভিমান ভুলে আবার তারা একত্রিত হয়, আড্ডায় মেতে ওঠে। বিভিন্ন বয়সী বন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেন হুমায়ুন ফরীদি, ফেরদৌস, আহমেদ রুবেল, হাসান মাসুদ, আরমান পারভেজ মুরাদ ও মারজুক রাসেল।
আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১)
মফস্বল শহরের স্কুলের ছাত্র রাশেদ আর তার বন্ধুরা মিলে উদ্ধার করে এক বন্দি মুক্তিযোদ্ধাকে। এরপর মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে যায় রাশেদ এবং রাজাকারের গুলিতে শহীদ হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক বছর পর বন্ধু ইবু তার ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে আসে কিশোরবেলার স্মৃতিমাখা সেই স্থানে, তখন মনে পড়ে রাশেদকে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মান করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। রাশেদের ভূমিকায় অভিনয় করেন চৌধুরী জাওয়াতা আফনান। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, গাজী রাকায়েত প্রমুখ।
এছাড়াও আরো বেশকিছু সিনেমায় বন্ধুত্ব ব্যাপারটিকে বেশ গুরুত্বের সাথে দেখানো হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘লালু ভুলু’, ‘অভিযান’, ‘নারীর মন’, ‘জাগো’, ও ‘মেঘের কোলে রোদ’। বাংলাদেশী দর্শক ও মানুষের মনস্তত্ত্ব গঠনে ঢাকাই সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ উপাদান বন্ধুত্ব বেশ জোরালো ভূমিকা রেখেছে বলতেই হয়।