‘অ্যাভাটার: ফায়ার অ্যান্ড অ্যাশ’
২০০৯ সালে প্রথম ‘অ্যাভাটার’ তৈরি হয়। আর তাতেই বদলে যায় ২১ শতকের বিশ্ব চলচ্চিত্রের গতি ও ভাষা। এরপর ২০২২ সালে আসে আরেক চাপ্টার। সেটিও পায় তুমুল জনপ্রিয়তা। সেই জনপ্রিয়তার সুবাদে আসে তৃতীয় চাপ্টার। গত শুক্রবার বিশ্বব্যাপী সিনেমাটির তৃতীয় কিস্তি ‘অ্যাভাটার: ফায়ার অ্যান্ড অ্যাশ’ মুক্তি পেয়েছে। মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশের স্টার সিনেপ্লেক্স ও ব্লকবাস্টার সিনেমাতেও। ‘অ্যাভাটার’ এর আরও কী সিক্যুয়েল আসবে কিনা সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।
‘অ্যাভাটার’ এর শুরু
২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে পরিচালক জেমস ক্যামেরন সিনেমায় আধুনিক প্রযুক্তির এক অভূতপূর্ব প্রয়োগ ঘটান। কল্পবিজ্ঞান জগতের ইতিহাসে ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ক্যামেরন থ্রিডি প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্যানডোরার সবুজ বন, আলোয় ঝলমলে জলপ্রপাত ও চোখ ধাঁধানো নক্ষত্রমণ্ডল তৈরি করেন। সিনেমার প্রতিটি দৃশ্য একটি চিত্রকর্মের মাধ্যমে প্রাণবন্ত হয়ে উঠে।

সিনেমার গল্পে দেখা যায়, নায়ক জেক সলির (স্যাম ওয়ারথিংটন) একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত মেরিন সেনা যিনি ‘অ্যাভাটার প্রোগ্রাম’ এর মাধ্যমে নাভি জনগোষ্ঠীর দেহে প্রবেশ করেন। জেকের লক্ষ্য ছিল শিল্প কোম্পানির স্বার্থে গ্রহের বিরল খনিজ ‘আয়োটাইট’ সংগ্রহ করা। কিন্তু নাভির সংস্কৃতি, বিশ্বাস, প্রকৃতি ও পরিবেশ তাকে ভিন্ন এক নতুন চেতনার দিকে ধাবিত করে । এর মাধ্যমে ক্যামেরন মানবতার মূল্য, প্রকৃতির সুরক্ষা এবং সংস্কৃতির মর্যাদা নিয়ে দর্শকের নতুন করে ভাবনা যুগিয়েছেন।
‘অ্যাভাটার’ এর ভাষা
সিনেমায় ব্যবহৃত নাভি ভাষা তৈরি করেছিলেন ভাষাতত্ত্ববিদ ড.পল আর. ফ্রমার। নাভি ভাষা তৈরিতে জেমস ক্যামেরন নির্দেশ দিয়েছিলেন। নির্দেশে ছিলো এটি যেন বাস্তব জগতের মানুষের ভাষার সঙ্গে মিলে না যায়। অভিনেতারা সহজে উচ্চারণ করতে পারে। এরপর প্রায় এক হাজার শব্দ তৈরি করা হয়েছে। তৈরি হয় ব্যাকরণ ও নতুন শব্দ ক্রম।
ছবির অডিশনের সময় স্যাম ওয়ার্থিংটন গাড়িতেই থাকতেন। এই কঠোর সময় পার করে তিনি জেক সলির চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পান। ১৯৯৯ সালে মুক্তির কথা থাকলেও বাজেটের কারণে প্রজেক্ট থমকে যায়। তবে আট বছর পর শুরু হয় শুটিং।
সিনেমার শুটিংয়ে পানির নিচে ৭ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের শুটিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন কেট উইন্সলেট। অর্থাৎ ৭ মিনিটের বেশি সময় ধরে পানির নিচে নিশ্বাস বন্ধ রেখে শুটিং করেছিলেন।
‘অ্যাভাটার’ ছিলো ২৩৭ মিলিয়ন ডলার বাজেটের সিনেমা। মুক্তির পর সিনেমাটি আয় করে ২ দশমিক ৯২৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

সিনেমার এর ব্যাপক সাফলের ১৩ বছর পর এর সিকুয়েল আসে আবার। প্রথম পর্ব মুক্তির ব্যাপক ব্যবসায়িক সাফল্যের পর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরেই সিনেমাটির মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বেশ কয়েকটি কারণে এতটা দেরি হয়ে গেল।
প্রথমত, গভীর সমুদ্রের মধ্যে সিনেমাটির শুটিং করা হয়েছে, সমুদ্রের যথাযথ লোকেশন খুঁজতে গিয়ে কয়েক বছর কেটে যায়। পুরো চিত্রনাট্য লিখেও বহুবার বদলাতে হয়। এ ছাড়া ছিল প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, বেশ কিছু নতুন প্রযুক্তি কেবল এই সিনেমার জন্যই আবিষ্কৃত হয়েছে! এরপর শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় কোভিড, ফল আরও কয়েক বছরের বিলম্ব।
সিকুয়েলটি মূলত নাভির জলজ প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর কেন্দ্রিত। ছবিতে জেক সলির চরিত্রে আগেরবারের মতোই ছিলেন স্যাম ওয়ার্দিংটন। এ ছাড়া আগের কিস্তির জোয়ি সালদানা, সিগুর্নি ওয়েভার, স্টিফেন লাংরাও।
‘অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অব ওয়াটার’ মুক্তির পর বক্স অফিসে বড় সাফল্য পায়। ৩৫০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের সিনেমাটি আয় করে ২ দশমিক ৩৪৩ বিলিয়ন ডলার।
‘অ্যাভাটার: ফায়ার অ্যান্ড অ্যাশ’
আগের কিস্তির মতো এই সিনেমার কেন্দ্রেও সলি পরিবার। আগের পর্বে নেটেয়ামের মৃত্যু তাদের জীবনে গভীর দাগ রেখে গেছে। সেই শোক, সেই লড়াই, তার মধ্যেই আসে নতুন বিপদ। ট্রেলারে দেখা যায়, এবার নতুন প্রতিপক্ষ ‘অ্যাশ ক্ল্যান’। এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছে ভারাং (ওনা চ্যাপলিন); যারা জেক সালি (স্যাম ওয়ার্থিংটন) ও নেইতিরির (জোয়ি সালদানা) জন্য নতুন হুমকি হয়ে উঠবে।
জেমস ক্যামেরন নতুন সিনেমাটি নিয়ে বলেন, ‘দর্শকেরা দেখবেন, সন্তানেরা বড় হয়ে নিজেদের পরিচয় খুঁজছে। কারণ, তাদের মা পুরোপুরি নাভি প্রজাতির। আর বাবা অন্য গ্রহ থেকে আসা। এই সংকর জীবন তাদের হাসি-আনন্দের সঙ্গে একঝাঁক চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসে। আমরা মূলত শরণার্থী বা বাস্তুচ্যুত অভিবাসীদের পারিবারিক অবস্থাকে দেখানোর চেষ্টা করেছি। মানুষ এটি দেখে সহজেই বাস্তবতার সংযোগ স্থাপন করতে পারবে।’

‘অ্যাভাটার’ সিনেমা মানেই প্রযুক্তির এক বিশাল চমক। এর সিনেমাটোগ্রাফি, অ্যানিমেশন বা কারিগরি , সবকিছুতেই থাকে নতুনত্বের ছোঁয়া। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না, এই সিনেমার সংগীত বা মিউজিকের ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা প্রযোজ্য।
দীর্ঘ সাত বছর
সুরকার সাইমন ফ্র্যাংলেন জানান, এবারের সিনেমার কাজ শেষ করতে তার দীর্ঘ সাত বছর সময় লেগেছে। এই দীর্ঘ যাত্রায় তিনি ১ হাজার ৯০৭ পাতার অর্কেস্ট্রা স্কোর বা স্বরলিপি লিখেছেন। এমনকি ভিনগ্রহের কাল্পনিক জগৎ ‘প্যান্ডোরা’র বাসিন্দাদের বাজানোর জন্য তিনি সম্পূর্ণ নতুন বাদ্যযন্ত্রও আবিষ্কার করেছেন।

৪০০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের ‘অ্যাভাটার: ফায়ার অ্যান্ড অ্যাশ’ ছবিটির বড় অংশের শুটিং হয়েছে নিউজিল্যান্ডে।
জোয়ি সালদানা যখন প্রথম ‘অ্যাভাটার’-এর নায়িকা নেইতিরি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তাঁর বয়স তখন ২০ এর একটু বেশি। ‘অ্যাভাটার: ফায়ার অ্যান্ড অ্যাশ’ নিয়ে যখন ফিরছেন তার বয়স আজ ৪৭।
‘অ্যাভাটার’ এর আরও সিক্যুয়েল আসবে কিনা সেটা দ্বিতীয় কিস্তি মুক্তির বছর কয়েক আগেই জানিয়েচ্ছিলেন ক্যামেরন। তিনি আরও তিন কিস্তির ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। জানিয়েছিলেন, চতুর্থ ও পঞ্চমটি মুক্তি পাবে যথাক্রমে ২০২৬ ও ২০২৮ সালে। ক্যামেরন বলেছিলেন, ‘সব কটিরই চিত্রনাট্য লেখা শেষ, ঘটনাক্রম থেকে শুরু করে সিনেমায় কী দেখাব, সেটা পুরোপুরি তৈরি।’
তবে ‘অ্যাভাটার: ফায়ার অ্যান্ড অ্যাশ’ মুক্তির আগে তিনি বলছেন ভিন্ন কথা। ক্যামেরন জানিয়েছেন, ছবিটির ফল দেখেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। ভ্যারাইটিকে নির্মাতা আরও জানিয়েছেন, শিগগিরই নতুন ‘টার্মিনেটর’ সিনেমার কাজও শুরু করবেন। তবে নতুন কিস্তিতে আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগার থাকবেন না।