ঋত্বিক কুমার ঘটকের জন্মশতবার্ষিকী
আজ ৪ নভেম্বর কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটক -এর জন্মশতবার্ষিকী। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) রাজশাহী শহরের মিঞাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন খ্যাতিমান এই পরিচালক। ঋত্বিক কুমার ঘটক ঋত্বিক ঘটক নামেই সবার কাছে পরিচিত।
কেউ কেউ তাকে খ্যাপাটে নির্মাতা নামেও চিনেন। ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে এক আবেগ ও শ্রদ্ধার নাম। তার নির্মিত সিনেমাগুলো সমাজের আয়না হয়ে আছে আজও। ভারতবর্ষের মননশীল ও জীবনভিত্তিক সিনেমার ভুবনে যাদের নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়, তাদের মধ্যে ঋত্বিক ঘটক অন্যতম আলোচিত নির্মাতা। সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেনের পাশে তার নামও স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।

ঋত্বিক কুমার ঘটক -এর প্রথম সিনেমা
ঋত্বিকের পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘নাগরিক’ তবে প্রথম মুক্তি পায় পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘অযান্ত্রিক’। প্রথম জীবনে কবি ও গল্পকার ছিলেন তিনি। পরে নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, এবং কালক্রমে চলচ্চিত্রকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন তিনি। তার কর্ম ও সৃজনক্ষেত্রের পরিধি শুধু চলচ্চিত্র পরিচালনা ও কথাসাহিত্যে সীমাবদ্ধ নয়। এসবের পাশাপাশি ঋত্বিক ঘটক ভারতের বিখ্যাত পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ সময়। মেধা ও মননে ঋত্বিক ঘটক ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ। এখনো তার নির্মিত সিনেমাগুলো দেখে আবেগে ভাসেন সিনেমাপ্রেমী দর্শক, গবেষক ও সিনেমাবোদ্ধারা।

ময়মনসিংহের মিশন স্কুলে তার লেখাপড়া শুরু হয়। ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পরে তার পরিবার কলকাতায় চলে যায়। পরবর্তী সময়ে কলকাতার বালিগঞ্জ স্কুলে ভর্তি হন তিনি। ১৯৫৮ সালে তিনি বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন কোর্স সম্পন্ন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু এমএ সম্পূর্ণ না করেই তিনি পত্রিকায় লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হন। সে সময় তিনি দেশ, শনিবারের চিঠি, অগ্রণী বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করেন। পত্রিকার পাশাপাশি মঞ্চ নাটকেও কাজ করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম নাটক লিখেন ‘কালো সায়র’। ১৯৫১ সালে ঋত্বিক ঘটক ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগ দেন। তিনি অসংখ্য নাটক রচনা করেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন এবং অভিনয়ও করেছেন।
নাটকের ঋত্বিক
১৯৫২ সালে তিনি ‘দলিল’ শিরোনামে একটি নাটক নির্মাণ করেন; নাটকটি ১৯৫৩ সালে ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন এক্সিবিশনে প্রথম পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। চলচ্চিত্রে তার আবির্ভাব হয় পরিচালক নিমাই ঘোষের হাত ধরে।
১৯৫০ সালে বাংলা সিনেমা ‘ছিন্নমূল’-এর মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে অভিষেক ঘটে তার। চলচ্চিত্রটিতে তিনি একই সঙ্গে সহকারী পরিচালক এবং অভিনেতা হিসেবেও কাজ করেন।
ঋত্বিকের চলচ্চিত্র ‘অযান্ত্রিক’ ১৯৫৮ সালে মুক্তি পায়। সুবোধ ঘোষের একটি ছোটগল্প থেকে তিনি এটা নির্মাণ করেন। সে সময় ভারতজুড়েই অন্যরকম আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সিনেমাটি।

প্রফেসর ঋত্বিক ঘটক
ষাটের দশকে ঋত্বিক ঘটক স্বল্প সময়ের জন্যে পুনেতে বসবাস করেন। ১৯৬৫ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সেখানকার ভাইস প্রিন্সিপাল হন। সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি শিক্ষার্থীদের নির্মিত দুটি চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এরও প্রায় এক যুগ পর ১৯৭২ সালে আবার চলচ্চিত্রে ফেরেন তিনি। এ সময় তিনি অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ করেন। শোনা যায়, ঋত্বিক কুমিল্লা বেড়াতে এসে খোঁজ পান অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের। উপন্যাসটি পড়ে তিনি এতোই অভিভূত হন যে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেন এটিকে তিনি সিনেমায় রূপ দেবেন। তার হাতের পাশে সেই মুহুর্তে কোন কাগজ না পেয়ে তার বোনের সাদা ওড়নায় এটির পরিকল্পনা লিখে ফেলেন। তারপরেই তিনি নির্মান করেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমাটি।
তার সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে-
নাগরিক (১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), মুক্তি (১৯৬৫), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭)।
ঋত্বিক ঘটকের কাহিনি ও চিত্রনাট্য-
মুসাফির (১৯৫৭), মধুমতী (১৯৫৮), স্বরলিপি (১৯৬০), কুমারী মন (১৯৬২), দ্বীপের নাম টিয়ারং (১৯৬৩), রাজকন্যা (১৯৬৫), হীরের প্রজাপতি (১৯৬৮),
অভিনয় করেছেন যেসব সিনেমায়-
তথাপি (১৯৫০), ছিন্নমূল (১৯৫১), কুমারী মন (১৯৫২), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), মুক্তি (১৯৬৫), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭)।
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র-
দ্য লাইফ অব দ্য আদিবাসিজ (১৯৫৫), প্লেসেস অব হিস্টোরিক ইন্টারেস্ট ইন বিহার (১৯৫৫), সিজার্স (১৯৬২), ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান (১৯৬৩), ফিয়ার (১৯৬৫), রঁদেভু (১৯৬৫), সিভিল ডিফেন্স (১৯৬৫), সায়েন্টিস্টস অফ টুমরো (১৯৬৭), ইয়ে কওন (হোয়াই/ দ্য কোয়েশ্চন) (১৯৭০), আমার লেলিন (১৯৭০), পুরুলিয়ার ছৌ (দ্য ছৌ ড্যান্স অফ পুরুলিয়া) (১৯৭০), দুর্বার গতি পদ্মা (দ্য টার্বুলেন্ট পদ্মা) (১৯৭১)।
অসমাপ্ত সিনেমা ও তথ্যচিত্র-
বেদেনি (১৯৫১), কত অজানারে (১৯৫৯), বগলার বঙ্গদর্শন (১৯৬৪-৬৫), রঙের গোলাপ (১৯৬৮), রামকিঙ্কর (১৯৭৫), Adivasiyon ka jiban shrot(১৯৫৫)।
৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ সালে ঋত্বিক কুমার ঘটক মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শের অনুরাগী। ১৯৭০ সালে ভারত সরকার তাকে শিল্পকলায় পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৪: যুক্তি তক্কো আর গপ্পো চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন ঋত্বিক।