স্মরণে পাপিয়া সারোয়ার
অকালে চলে যাননি কন্ঠশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অনেকদিন ভুগে পাপিয়া সারোয়ার চলে গিয়েছিলেন গত বছরের ১২ ডিসেম্বর। এখন আর আদতেই তাকে তাঁর গানের মতোই, টেলিফোন টেলিগ্রাম পিয়ন দিয়ে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। দুই দেশের বৈরী সম্পর্কের ভেতরেই না ফেরার দেশে নীলিমা সেন, শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য এ শিক্ষার্থীটি। বেঁচে থাকতে যিনি তাদের থেকে শেখা রবীন্দ্রসংগীতকে আগলে রেখেছিলেন পরম যত্নে। পাপিয়া সারোয়ার ছিলেন রবীন্দ্র ভূবনের ধ্রুবতারা ।

পাপিয়া সারোয়ার একজন অসামান্য শিল্পী বললেও কম বলা হয়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রবীন্দ্র ভূবনে অন্যতম ধ্রুবতারা। সেই ১৯৬৭ সালেই বেতারে ও টেলিভিশনে কণ্ঠশিল্পী হিসাবে তালিকাভুক্ত হন। তাঁর শিক্ষক ছিলেন সনজীদা খাতুন, জাহিদুর রহিম ও ওয়াহিদুল হকের মতো দিকপালেরাও। পড়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে। তবুও তিনি দেশ স্বাধীন হবার পর শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়েছিলেন বৃত্তি পেয়ে। সেখানে তিনি পান কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের মত কিংবদন্তী মানুষদের স্নেহ ও ভালোবাসা। আর শিক্ষার্থী হিসাবে লাভ করেন শান্তি নিকেতনের মুক্ত পরিবেশে রবীন্দ্র ভূবনের জ্ঞান ও অবারিত খোলা হাওয়া।
রবীন্দ্র ভূবনের ধ্রুবতারা হয়ে উঠা
সেখান থেকে পড়ে এসে তিনি শুধু শিল্পী হয়েই থাকেননি। হয়েছেন দেশবরেণ্য খ্যাতিমান রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষক। ছায়ানট সহ আরো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানে শিখিয়েছেন গান। নিজেও তৈরী করেছেন সংগঠন। আর রবীন্দ্র সংগীতের চর্চা তো করেই গেছেন নিরলস প্রচেষ্টায়। তাঁর গাওয়া রবীন্দ্র সংগীত সরাসরি শোনা এক পরম অভিজ্ঞতা। নিবিষ্ট চিত্তে ধ্যানে মত্ত হয়ে তিনি গাইতেন যেকোনো রবীন্দ্রনাথের পূজা ও প্রেম পর্যায়ের গান। আমি অনেকদিন আগে এক অনুষ্ঠানে শুনেছিলাম ‘হৃদয়ের একূল অকূল দুকূল ভেসে যায়’। এমন না যে এই গানটা আগে আমি শুনিনি ভালো শিল্পীদের কন্ঠো। কিন্তু তার কন্ঠের যে প্রেজেন্স তা বিস্ময়কর। আচ্ছন্ন করে রাখে শ্রোতাদের। আরেকটা গান তিনি গাইতেন, ‘আমি অকৃতি অধম’। শুনলেই মনে হতো স্বর্গীয়।
পাপিয়া সারোয়ারের সাথে যারা মিশেছেন ও যারা তাঁর ছাত্রছাত্রী তাদের মুখে বারবার উচ্চারণ হয়েছো তার মানবিক গুনাবলী সম্পন্ন আচরণের কথা। তিনি পরম স্নেহে আগলে রাখতেন সবাইকে। মাথায় হাত বুলালেই মনে হতো এরকম মানুষ পাশে থাকা কত জরুরী। পাপিয়া সারোয়ার কারো নামে কোনো পরনিন্দা কিংবা সমালোচনা কখনো করতেন না। জীবনকে তিনি রবীন্দ্রনাথের মতোই ঋষিতুল্য যাপনে পরিণত করেছিলেন। তিনি একুশে পদক পেয়েছেন, বাংলা একাডেমী ফেলোশিপ পেয়েছিলেন, ছিলেন রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সংস্থার সভাপতি। এসব পদ-পদবী নিয়ে তিনি বিন্দু মাত্র মোহে পড়েননি। অসুস্থ হবার আগ পর্যন্ত নিয়মিত স্বর ও সুর সাধনাই ছিল তার প্রধান কাজ। গানকে জীবনের প্রাত্যহিক ব্যাপার হিসাবেই দেখতেন। তাই গান থেকে তিনি কখনো বিচ্যুত হননি। এই গানে গানেই তাকে বিদায় দেয়া হয় এ ভূবন থেকে।

‘নাই টেলিফোন নাইরে পিওন’
তবুও পাপিয়া সারোয়ার আমজনতা থেকে দূরেই থাকতেন যদিনা তাঁকে দিয়ে মনিরুজ্জামান মনির, ‘নাই টেলিফোন নাইরে পিওন’ না গাওয়াতেন। গানটা তাঁকে অসম্ভব জনপ্রিয় করে তোলে। এই জনপ্রিয়তার অন্ধ হয়ে তিনি আরো এসব গানে নিযুক্ত হননি। এমনকি সিনেমাতেও এই গান গেয়েছে, রুনা লায়লা। তবে তিনি এটা নিয়ে অনুশোচনা করতেন না। গাইতেন ইচ্ছে হলেই। অনেক অনুরোধও আসতো গাইবার। সেটা তিনি উপভোগই করতেন। মনিরুজ্জামান মনিরকে মজা করে বলেছিলেন, ‘আপনি আমাকে একটা বিপদে ফালাইছেন’। কিন্তু অনান্য শিল্পীদের মতো তিনি জনরুচিকে নিয়ে তামাশা করতেন না। খুবই আন্তরিকতা সাথে তিনি গানটা গাইতেন। মনেই হতো না তিনি একজন অত্যন্ত সিরিয়াস রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী। তার এই ব্যক্তিত্বটুকু মনে থাকবে আজীবন। শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি রবীন্দ্র ভূবনের ধ্রুবতারা, মহারথী এই শিল্পীকে।
লেখক: আরাফাত শান্ত