নিউইয়র্ক সিটি মেয়র জোহরান মামদানি
নিউইয়র্ককে বলা হয় পৃথিবীর রাজধানী। এই শহরেই শিল্প, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থ-সম্পদ এবং প্রতিবাদের ভাষা একাকার হয়ে আছে। আর এই শহরের নেতৃত্বে আজ উঠে এসেছেন এমন এক একজন যিনি শিল্প, সংস্কৃতি ও রাজনীতির এক অভূতপুর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। র্যাপার থেকে হয়ে উঠেছেন পৃথিবীর রাজধানী নিউইয়র্কের সিটি মেয়র। তিনি জোহরান মামদানি। মামাদানি হয়ে উঠেছেন এক নতুন ধারার প্রতীক, যেখানে সংগীত, সিনেমা, সাহিত্য ও মানবিক চিন্তা রাজনীতির ভাষা হয়ে উঠেছে। র্যাপার থেকে নিউইয়র্ক সিটি মেয়র; সংস্কৃতি ও রাজনীতির নতুন সংলাপ এ উঠে এসেছেন তিনি।

মামদানির সিনেমায় বেড়ে উঠা
জোহরান মামদানি জন্মেছিলেন উগান্ডায়, এক দক্ষিণ এশীয় প্রবাসী পরিবারে। শৈশব থেকেই তার জীবনে প্রভাব ফেলেছে বহুমাত্রিক সংস্কৃতি। আফ্রিকার প্রাণশক্তি, দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্য এবং আমেরিকার স্বাধীনচেতা নাগরিক বোধ তাকে গড়ে তুলেছে এক কসমোপলিটান ব্যক্তিতে। জোহরান মামদানি জন্মেছেন বিখ্যাত নির্মাতা মীরা নায়ারের গর্ভে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই চলচ্চিত্র নির্মাতা মনসুন ওয়েডিং, দ্য নেমসেক ও সালাম বম্বে! এর মতো সিনেমায় তুলে ধরেছেন সমাজ, প্রেম, অভিবাসন ও মানবিকতার মতো জটিল সব সম্পর্ক।
ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে সিনেমার সেটে সেটে ঘুরে বেড়াতেন মামদানি। এই ঘুরে বেড়ানোতেই জোহরান বুঝে গিয়েছিলেন শিল্প মানে শুধু সৌন্দর্য নয়, এটি সমাজের আয়না। মায়ের চলচ্চিত্রে যেমন তিনি দেখতে পেয়েছেন শহুরে জীবনের বৈষম্য, পরিবারিক টানাপোড়েন ও ভালোবাসার মানবিক রূপ, পরবর্তীতে মায়ের সেই চিন্তাকেই জোহরান তার র্যাপে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার গানে উঠে এসেছে অভিবাসী তরুণদের সংগ্রাম, শ্রেণি বৈষম্য, ও নাগরিক অধিকারের আহ্বান।
মায়ের কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন শিল্পের শক্তি হলো সহানুভূতি যেখানে মানুষের গল্প বলাই প্রধান আরাধ্য। এই মানবিক শিক্ষাই তাকে তৈরি করেছে এমন এক নেতা হিসেবে, যিনি রাজনীতিকে কেবল ক্ষমতার প্রতিযোগিতা নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরেছেন সবার কাছে।
মীরা নায়ার শুধু তার মা নন, তার মানসিক গঠনের স্থপতি। জোহরান নিজেই একবার বলেছিলেন, “আমি রাজনীতি শিখিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, আমি শিখেছি সিনেমার সেটে দাঁড়িয়ে, যেখানে মা দেখাতেন। একটি দৃশ্যের ভেতরেও কত জীবনের গল্প লুকিয়ে থাকে।”

র্যাপের ছন্দে প্রতিবাদ ও সচেতনতা
রাজনীতিতে প্রবেশের অনেক আগে থেকেই জোহরান ছিলেন এক আন্ডারগ্রাউন্ড র্যাপার। তার গানগুলো ছিল নাগরিক বঞ্চনা, পুলিশি নিপীড়ন, আবাসন বৈষম্য ও অভিবাসী জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমার কাছে র্যাপ মানে ছিল বাস্তবতাকে ছন্দে রূপ দেওয়া—যেন মানুষ শুনে, ভাবে এবং বদলিয়ে দিতে পারে।”
তার র্যাপ গানে পাওয়া যায় কবিতার গভীরতা, সাহিত্যের ভাষা ও রাজনৈতিক বার্তা। এই তিনের মিশ্রণই তাকে আলাদা করেছে সাধারণ সংগীতশিল্পীদের থেকে। তিনি বলতেন, “আমি মঞ্চে রাজনীতি করিনি, কিন্তু রাজনীতিকেই সংগীতে এনেছি।”
জোহরানের সংগীতচর্চা তাকে তৈরি করেছে এক তীক্ষ্ণ শ্রোতা ও গল্পকার হিসেবে। এই গল্প বলার ক্ষমতাই পরে তাকে রাজনীতির প্রচারণায় এগিয়ে দিয়েছে। যেখানে তার প্রতিটি বক্তৃতা, প্রচারচিত্র বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভিডিও ছিল একেকটি শিল্পসম্মত প্রকাশ।
শিল্পের ছোঁয়ায় ডিজিটাল ক্যাম্পেইন
জোহরানের নির্বাচনী প্রচারণা ছিল এক কথায় অভূতপূর্ব। তিনি প্রচলিত রাজনীতির নিস্তেজ ভাষা ভেঙে সেখানে এনে দিয়েছেন শিল্প ও সাহিত্য ও রাজনীতিবোধে ভরা এক মানবিক প্রচারণা।
তার ক্যাম্পেইনের মূল ধারণা ছিল ফ্রম রিদম টু রিফর্ম অর্থাৎ ছন্দ থেকে সংস্কারে। এই স্লোগান আসলে নিছক কোন বাক্যই নয়, বলা যায় মামদানির পুরো জীবনদর্শনের প্রতিফলন এই থিম।
মামদানি তার অভিনব প্রচারণায় ব্যবহার করেছেন সংগীত, কবিতা, ছোট চলচ্চিত্র, ফটোগ্রাফি, এমনকি থিয়েটারের উপাদানও। তার টিমে ছিলেন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা, গ্রাফিক ডিজাইনার, কবি ও মিউজিশিয়ান থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্যের সব আঙ্গিকের মানুষ যারা রাজনৈতিক বার্তাকে রূপ দিয়েছিলেন সৃজনশীল শিল্পকর্মে।
মামদানীর প্রতিটি সোশ্যাল মিডিয়া ভিডিও বানানো হতো সিনেমার মতো পরিকল্পনা করে যেখানে ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিং, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, ছন্দ, আবেগ ও বার্তা একসাথে তুলে ধরতো এক নতুন রাজনীতি, নতুন সংস্কৃতি। ফলে মামদানির বক্তৃতা কেবল কয়েকটি গালভরা কথাই থাকেনি তা হয়ে উঠেছে রাজনীতি ও সৌন্দর্যতত্ত্বের এক চমৎকার প্রদর্শনী।
তিনি নিউইয়র্কের রাস্তাঘাট, সাবওয়ে ও পার্কগুলোকে বানিয়েছিলেন তার প্রচারণার স্টেজ। যেখানে তিনি মানুষকে বলতেন—“এই শহর আমাদের, তাই এর গল্পও আমাদের বলতেই হবে।”
সাহিত্যের প্রভাব: রাজনীতিতে গল্প বলার শক্তি
জোহরান তার বক্তৃতায় প্রায়ই সাহিত্যিক উদ্ধৃতি দিতেন—জেমস বল্ডউইন, টনি মরিসন, কাজি নজরুল, কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত। তিনি বিশ্বাস করতেন, “সাহিত্য মানুষকে চিনতে শেখায়, আর রাজনীতি সেই মানুষকে বাঁচতে শেখায়।”
তার প্রচারণার ভাষায় ছিল কবিতার সুরে, গানের ছন্দে। তিনি বলেছেন “আমরা সবাই এই শহরের গল্পের চরিত্র, কেউ নায়ক নয়, কেউ পার্শ্বচরিত্র নয়। আমাদের কণ্ঠগুলো মিলেই নিউইয়র্কের গান।”
এই সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে আলাদা করেছে প্রচলিত রাজনীতিকদের থেকে। যেখানে অন্যরা নীতির পরিসংখ্যান নিয়ে কথা বলেন, সেখানে জোহরান বলেন গল্প, এক অভিবাসী মা, এক নির্মাণ শ্রমিক, বা এক শিল্পীর জীবনের।

শিল্প ও সংস্কৃতির জন্য তার প্রতিশ্রুতি
মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর জোহরান তার প্রথম প্রেস কনফারেন্সেই ঘোষণা দেন, “নিউইয়র্ককে আমি এমন এক শহর বানাতে চাই, যেখানে শিল্পকে দেখা হবে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে।”
তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রতিটি বরোতে কমিউনিটি আর্ট সেন্টার গড়ে তোলা হবে, যাতে স্থানীয় তরুণ শিল্পীরা বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনীর সুযোগ পায়।
‘আর্ট ফর অল’ ফান্ড চালু করা হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। যেখানে শহরের বাজেটের নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ থাকবে শিল্প ও সাহিত্য উন্নয়নের জন্য। এছাড়া শহরের স্কুলগুলোতে আর্ট এডুকেশন বাধ্যতামূলক করা হবে, যেন নতুন প্রজন্ম সৃজনশীলতায় বেড়ে ওঠে।
তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, “যে শহর সঙ্গীত ও সিনেমা তৈরি করে, তাকে শিল্পীদের জন্যও নিরাপদ আশ্রয় হতে হবে।” এজন্য তিনি সাশ্রয়ী আবাসন কর্মসূচিতে শিল্পীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
শহরের লাইব্রেরিগুলোকে রূপ দেওয়া হবে “কালচার হাব” হিসেবে যেখানে বই, সংগীত ও ডিজিটাল মিডিয়ার মধ্যে সংযোগ ঘটানো হবে।
নতুন নিউইয়র্ক সিটি: শিল্প, নাগরিকতা ও ন্যায়বোধের মিলন
জোহরান মামদানি এখন শুধু একজন মেয়র নন; তিনি এমন এক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধি, যেখানে শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও সিনেমা রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মামদানি তার নীতি নির্ধারণে শিল্পচর্চা, সংস্কৃতিতে বিনিয়োগ ও মানবিক শিক্ষাকে সমান গুরুত্ব পাবে।
তার বক্তব্যে তিনি প্রায়ই বলেন, “আমরা যদি একটি শহরের অর্থনীতি গড়ি কিন্তু তার আত্মাকে না লালন করি, তবে সেটি শহর নয়, কেবল ইট-পাথরের জঙ্গল। আমি চাই নিউইয়র্ক তার আত্মা ফিরে পাক—সংগীত, সিনেমা ও মানবতার মাধ্যমে।”
আজ তার নেতৃত্বে নিউইয়র্ক সিটি নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে—যেখানে রাজনীতি শুধু ক্ষমতার নয়, সংস্কৃতিরও আন্দোলন।
জোহরান মামদানির গল্প প্রমাণ করে, শিল্প ও রাজনীতি পরস্পরবিরোধী নয়; বরং একে অপরের পরিপূরক। সংগীতের ছন্দ, সিনেমার দৃশ্য, সাহিত্যের ভাষা—সব মিলেই গড়ে উঠেছে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। তার জীবন দেখায়, পরিবর্তন কেবল আইন দিয়ে নয়, শিল্পের মাধ্যমে সম্ভব।
আজ নিউইয়র্কের মেয়র জোহরান মামদানি বিশ্বকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন—রাজনীতি যখন শিল্পের সঙ্গে মিশে যায়, তখনই সমাজ নতুন ছন্দে জেগে ওঠে।