১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বাংলার আপামর জনতা। এই কথা তো কারো অজানা নয়। কিন্তু জানেন কি, বাংলার সাধারণ জনতার মাঝে ছিলেন দেশীয় শোবিজের কয়েকজন তারকারাও? বাংলাদেশের অভিনয় জগত কিংবা সংগীত জগতে দাপিয়ে বেড়ানো কয়েকজন নক্ষত্র ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন অস্ত্র হাতে। শোবিজের যে তারকারা ছিনিয়ে এনেছিলেন স্বাধীনতা, স্বাধীনতার মাসে সেই তারকাদের নিয়েই চিত্রালীর আজকের বিশেষ লেখা।
বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মিয়া ভাই’ খ্যাত নায়ক ফারুক
আসল নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। চলচ্চিত্র জগতে যিনি পরিচিত ফারুক নামে। স্কুল জীবন থেকেই তিনি সম্পৃক্ত হন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে। প্রতিটি সংগ্রাম ও আন্দোলনে তিনি যথার্থ সাহসিকতার সাথে অবদান রেখেছেন। ১৯৬৬ সালে যোগ দেন ছয় দফা আন্দোলনে। সে সময়ে তার নামে দায়ের করা হয় প্রায় ৩৭টি মামলা। এরপর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন তিনি।
স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়ী হয়ে সেই বছরই এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অভিনয়ে যাত্রা শুরু করেন ফারুক। এরপর তিনি অভিনয় করেছেন ‘লাঠিয়াল’, ‘সুজন সখী’, ‘নয়নমনি’, ‘সারেং বৌ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সাহেব’, ‘আলোর মিছিল’, ‘দিন যায় কথা থাকে’ এবং ‘মিয়া ভাই’-সহ শতাধিক চলচ্চিত্রে।
অ্যাকশন হিরো জসীম
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া তারকাদের তালিকায় আছেন বাংলাদেশে অ্যাকশন ছবির পথিকৃত নায়ক জসীম। বড় পর্দায় এই অভিনেতাকে যেমন শত্রুপক্ষের বিপক্ষে লড়াই করতে দেখা গেছে, তেমনই মহান মুক্তিযুদ্ধেও লড়াই করেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে!
পুরো নাম আবুল খায়ের জসীম উদ্দিন। সংক্ষেপে নায়ক জসীম নামেই তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক পরের বছর ‘দেবর’ সিনেমার মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় তার। খলনায়ক হিসেবে অভিনয় শুরু করলেও পরবর্তীকালে নায়ক হিসেবেও সফলতা পান তিনি। তার খলনায়ক জীবনের সমাপ্তি ঘটে ‘সবুজ সাথী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে।
এর আগে ১৯৭১ সালে জসিম স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেন একজন সৈনিক হিসেবে। দুই নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তিনি।
চিত্রনায়ক সোহেল রানা
মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা। যিনি একাধারে একজন অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক। তিনি চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সোহেল রানা নাম ধারণ করে। তবে মাসুদ পারভেজ নামে তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন ১৯৭২ সালে। বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ ছবির প্রযোজক হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ তার। অভিনেতা হিসেবে সোহেল রানার অভিষেক হয় ১৯৭৩ সালে। কাজী আনোয়ার হোসেনের পরিচালিত বিখ্যাত কাল্পনিক চরিত্র মাসুদ রানা সিরিজের একটি গল্প অবলম্বনে ‘মাসুদ রানা’ ছবিতে নায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন তিনি।
এর আগে শিক্ষা জীবনে সোহেল রানা একজন ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঝাপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
স্টাইল আইকন জাফর ইকবাল
আশির দশকের একজন জনপ্রিয় অভিনেতা ও স্টাইলিশ হিরো জাফর ইকবাল। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন তিনি। তার অভিনীত প্রথম ছবির নাম ‘আপন পর’।
জাফর ইকবাল একাধারে একজন সংগীত শিল্পী, অভিনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে সরাসরি অংশ নেন তিনি। যুদ্ধের আগে ১৯৬৬ সালে প্রথম একটি ব্যান্ড দল গড়ে তোলেন তিনি। তার প্রথম সিনেমায় গাওয়া গান ছিল ‘পিচ ঢালা পথ’। তার কণ্ঠে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’ গানটি একসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
পপ গানের সম্রাট আজম খান
বাংলাদেশের যে সংগীতশিল্পীকে বলা হয় পপ ও ব্যান্ড সংগীতের সম্রাট, তিনি হলেন পপ তারকা আজম খান। পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান হলেও তিনি সংগীত জগতে আজম খান নামেই পরিচিত।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। এতো অল্প বয়সেই দেশের জন্য অস্ত্র হাতে নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। সে সময় ঢাকায় সংঘটিত কয়েকটি গেরিলা অভিযানে অংশ নেন তিনি। তার বাবা আফতাব উদ্দিন খান সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। বাবার অণুপ্রেরণায়ই যুদ্ধে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের পর পড়ালেখায় আর অগ্রসর হতে পারেননি তিনি। ঢুকে পড়েন সংগীত জগতে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর প্রথম কনসার্ট প্রদর্শিত হয়। আজম খানের জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে, ‘রেল লাইনের ঐ বস্তিতে’, ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেক’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘অনামিকা’, ‘অভিমানী’, ‘আসি আসি বলে’ ইত্যাদি।
এই পাঁচ তারকা ছাড়াও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা তারকাদের মাঝে রয়েছেন তুখোড় টিভি ও চলচ্চিত্র অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর, সৈয়দ হাসান ইমাম ও ‘কণ্ঠযোদ্ধা’ হিসেবে খ্যাত প্রয়াত সংগীতশিল্পী আব্দুল জব্বার।
লেখা: রাহনামা হক