বিজয় দিবসে দেশের গান নিয়ে কিছু কথা
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। আবার শুরু হওয়া নতুন কুড়িতে আমার সবচেয়ে প্রিয় বিভাগ হলো দেশাত্মবোধক গান। বাচ্চারা কি সুন্দর গায়। অংকিতা নামের একটা মেয়ের তো পুরো শাহনাজ রহমাতুল্লাহর মত নিবেদন। তখনকার সরকারী ফরমায়েশি গানের বাইরেও প্রতিটা দেশের গান লিখতে কি পরিমান পরিশ্রম হতো আমরা ভাবতে পারবো না সেই গল্প। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, আনোয়ার পারভেজ, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আলাউদ্দিন আলীরা দেশের গানের জন্য টাকা নিতেন না। উল্টো বিটিভিতে যেন প্রচার হয়, সাবিনা ইয়াসমিন ও শাহনাজ রহমতুল্লাহ এবং রুনা লায়লার মতো বড় শিল্পীরা আসতেন প্রায় ফ্রিতে গান ও সারাদিন ব্যাপী ভিডিও রেকর্ড করাতে। মন মাতানো দেশের গানে মনে পড়ে যাদের কথা, তাদের কথাই বলি।

আমাদের বিটিভির সময় একটা গানের কথা বলি আজ। সাদা শাড়ী পরে সাবিনা ইয়াসমিন গাইছেন, সেই রেললাইনের ধারে মেঠোপথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে। গানটা পুরোটাই রফিকুজ্জামান তার মা এর উপরে লিখেছেন। তার মা যুদ্ধের পর প্রায়শই দাঁড়িয়ে থাকতেন ট্রেন লাইনের দিকে তাকিয়ে, হয়তো তার শহীদ সন্তান ফিরে আসতেও পারে। আসাদের বাবা বলে ভয়াবহ নির্যাতনের স্বীকার তার বাবা। বাসায় রান্না বান্নাও হয় না, তলিয়ে যাওয়া সংসার। তার অনেকদিন পর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সাথে দিনের পর দিন বসে এ গানটা প্রস্তুত হয়। ইমতিয়াজ বুলবুল লেখাটা পড়তে পড়তে কেঁদে ফেলতেন। তার মনে হতো রমনা থানার সেই আটকে থাকার গল্প। যেখানে আশি জনকে হাজতে রাখা ছিল, প্রতিদিন সাতজন সাতজন করে নিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে মেরে ফেলছে। এসব ট্রমার গল্প আমি বারবার করতে চাই। কারন এই জাতির বড় একটা অংশ এত বিস্মৃতিপ্রবণ।
অসাধারণ সব দেশের গান সুর করে, কিছু গান লিখেও, সাবিনা ইয়াসমিনকে দিয়ে গাইয়ে, দুইটা জেনারেশনকে মন মাতানো দেশের গান শুনিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন তিনি। মুগ্ধ করার প্রাইজ হিসাবে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল দুই নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পাওয়া আওয়ামী লীগ আমলের আড়াই কাঠা জমি বিএনপি আমলে কেড়ে নেয়ে হয়েছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালের সাক্ষী দেয়ার কারনে তার ভাই খুন হয়েছে। তিনিও অকাল প্রয়াত হবার আগ পর্যন্ত ভয়ে ভয়ে চলতেন, সেই জমিও আর পান নি। সামিনা চৌধুরীকে দিয়ে তাই মজা করে গান গাইয়েছেন, আমি জায়গা কিনবো কিনবো করে, পেয়ে গেলাম জায়গা শুদ্ধ বাড়ী। তাই দেশের গান শুনলে চোখে পানি আসে সত্য, মাঝেমধ্যে মেজাজ খারাপও হয়।

মন মাতানো দেশের গানে মনে পড়ে যে দুজনকে
দেশের গানে আমার প্রিয় শিল্পী মুলত দুই জন। এক- শাহনাজ রহমাতুল্লাহ, দুই- সাবিনা ইয়াসমিন। এই দুইজন বাদে আবদুল হাদী, আব্দুল জব্বারও আমার প্রিয়। এছাড়া আর তেমন কেউ প্রিয় নাই। শাহনাজ রহমাতুল্লাহর ‘আমারও দেশেরও মাটির গন্ধ’ শুনছিলাম ইউটিউবে, মনে হচ্ছিলো কি সাংঘাতিক ভালো গান এইটা! আবার যখন লাউড স্পিকারে ‘ একতারা তুই দেশের কথা’ বাজে তখন মনে হয় এ যেন সমগ্র জাতির প্রানের আকুতি। বিভিন্ন মন খারাপের দিনগুলোতে সাবিনা ইয়াসমিনের ‘সব কটা জানালা’ শুনেছিলাম তখন আবেগে চোখে পানি আসতে আসতে মনে হয় এতো আমাদেরই বিজয়ের গান। ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’ বা ‘ এক সাগরে রক্তের বিনিময়ে’ ভয়াবহ একাত্তরের নৃশংসতা আর বর্বরতায় লাখো প্রানের আত্মাহুতির কথাই মনে পড়ে। সায়ানের কন্ঠে শাহনাজ রহমাতুল্লাহর ‘সোনামুখি’ গানটার আশ্চর্য সরলতা আমাকে বিমোহিত করে। একই শিল্পীর ‘আমায় যদি প্রশ্ন করে’ বা ‘প্রথম বাংলাদেশ’ এই গান দুটিও আমাকে সজীবতা দান করে নিমিষে!

ফরিদা পারভীনের ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ গানটার সুর মামা প্রায়ই বাঁশীতে তুলতো। লোডশেডিংয়ের রাত গুলোতে মন লাগিয়ে শুনতাম। আব্দুল হাদীর ‘যে মাটির বুকে’ গানটা আমার অত্যন্ত প্রিয়, গাইতে পারি না কখনোই তার আগেই চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে! যে কারো কন্ঠে ‘ও আমার দেশের মাটি’ গানটা শুনলেও মুগ্ধ হই। ‘ও আমার আমার বাংলা মা তোর’ এই গানটাও আমার প্রিয়। আবদুল জব্বারের ‘ সালাম সালাম হাজার সালাম’ কিংবা ‘মা গো ভাবনা কেন’ খুব পছন্দ করলেও গান গুলো শোনা হয় না তেমন। আমার এই দেশের গানের প্রতি এত ভালোবাসার একটা বড় কারন বিটিভি, বিটিভি যদি না থাকতো তবে এত জাদুময় সব গান কোথায় পেতাম শুনতে। ছোটবেলার পরিবেশও বড় ব্যাপার, স্কুলে আমার কিছু বুঝতে না বুঝতেই যখন ম্যাডামের শুনতাম ‘যদি মরনের পরে কেউ প্রশ্ন করে’ তখন থেকেই হয়তো দেশের গানের প্রতি এই ভালোবাসাটা শুরু হয়ে গেছে!
আগে তপন চৌধুরী, শাকিলা জাফর বা মনির খানেরাও বছরে বিশেষ দিবস উপলক্ষে দেশের গানের মিক্সড এ্যালবাম বের হতো। এখন ওসব বন্ধ, অডিও শিল্পীতেই ব্যাপক ধ্বস নেমে গেছে। কবে ঠিক হবে জানা নেই! তবে শাহবাগের সেই দিন গুলো ছিল দেশের গানের শ্রেষ্ঠ সময়, নানান মাইক থেকে নানান ভাবে ভেসে আসা দেশের গান মুগ্ধ করতো। তবে সেই খানেও কই থেকে জানি বাজে ও বিকৃত সুরে কিছু দেশের গান শুনতাম, নাম না জানা সেই সব শিল্পীদের নিয়ে মেজাজও খারাপ হতো। তবে হাসির ব্যাপারও ছিল, ওরে সাম্পানওয়ালার সুরে শুনতাম- ‘ওরে কাদের মোল্লা তোর কেন ফাঁসী হইলো না!’ সেইসব এখন শুধু স্মৃতি! এমনকি জুলাই অভ্যুত্থানেও অনেকে বারবার ফিরে গেছে দেশের গানে।

দেশের গানে টোটো বর্ণমালা তৈরির অনুপ্রেরণা
রুনা লায়লার দেশের গান ভিন্ন আঙ্গিকের। সেগুলো হয়তো খুব বিখ্যাত হয়নি কিন্তু অত্যন্ত মমতা মাখা। কবি শামসুর রাহমান থেকে নজরুল ইসলাম বাবু কে লিখে নাই। ‘এ দেশ আমার চোখের আলোয় থেকে’ ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো’। কয়েক বছর আগে ভারতের পদ্মশ্রী পেয়েছিল টোটো সম্প্রদায়ের মানুষ, ধনিরাম টোটো। আলিপুরদুয়ারে তিনি যেখানে থাকেন সেখান দেড় দু হাজার টোটো সম্প্রদায়ের মানুষ থাকে। বিপন্ন একটা ভাষায় গরিবী জীবন এই প্রান্তিক মানুষগুলোর। ধনিরাম টোটো পদ্মশ্রী পেয়েছেন টোটো বর্ণমালার লিখিত রূপ তৈরির জন্য। তিনি ৩৭ শব্দের অক্ষর রাশি তৈরি করেছেন। সঙ্গে টোটো সাহিত্যে প্রচুর কবিতা, উপন্যাস ও রচনা সৃষ্টি করে টোটো সমাজে নিজেকে খানিক অন্য উপমায় প্রতিস্থাপন করেছেন। এসব কিছুই শুরু হতো না তিনি যদি রেডিওতে একটা বাংলাদেশি গান না শুনতেন। খন্দকার নুরুল আলমের সুরে, কবি শামসুর রাহমানের লেখা, ফসলের মাঠে মেঘনার তীরে। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের বিপুল মানুষ এই গানটা শোনে নাই। সেই গানটি হল–‘ফসলের মাঠে, মেঘনার তীরে ধুলোবালু চরে, পাখিদের নীড়ে, তুমি আমি লিখি প্রাণের বর্ণমালা…’ তখনই তাঁর মাথায় আসে টোটো বর্ণমালা তৈরির কথা। তিনি বলেন, ‘সেই গানটা শুনে আমার ভিতরে নাড়া দেয়। প্রত্যেকের তো নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে তাহলে। আমাদের কেন নিজস্ব বর্ণমালা থাকবে না।’
এমন না যে পদ্মশ্রী পেয়ে তাদের জীবন বদলে গেছে। তাঁর ছেলেই মাস্টার্স পাশ চাকরী পায় নাই। তবুও একটা মহতী কাজের শুরুতে, একটা বিপন্ন ভাষার জেগে উঠার প্রয়োজনে রুনা লায়লার গানের একটা সামান্য ভুমিকা ছিল, এই ব্যাপারটা ভাবতে আমার ভালো লাগে।
লেখকঃ আরফাত শান্ত