মাতৃত্বের ত্যাগ: রাজকন্যার অন্তর্ধান
- প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৩০ PM , আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৪:৫২ PM

'আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি' গানটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে এক রাজকন্যা প্রতিম নায়িকার ছবি। যে রাজকন্যা একচ্ছত্রভাবে রাজত্ব করেছেন ভারতীয় উপমহাদেশের রুপালি পর্দায়। কিন্তু সব রাজকন্যার জীবনই কি সুখের হয়? কেননা এই রাজকন্যাকে তার স্বপ্নের রাজ্যকে শেষ পর্যন্ত হৃদয়ভারাক্রান্ত হয়ে ছেড়ে দিতে হয়েছিল।
কথা হচ্ছে ভারতীয় উপমাহাদেশের যশস্বী আভিনেত্রী শবনমের কথা যার ঝুলিতে রয়েছে উর্দু, বাংলা ও পাঞ্জাবী ভাষায় নির্মিত ১৮০ টি ছবি করার দুর্লভ ইতিহাস। তিনি এই পর্যন্ত বাগিয়েছেন ১৩ টি নিগার পুরস্কার যা যেকোন আভিনেত্রীর জীবনে দেখা মেলা ভার। সর্বশেষ তাকে ২০১৯ সালে পাকিস্তানের লাক্স স্টাইল অ্যাওয়ার্ডসের মঞ্চে দেখা যায় আজীবন সম্মাননা পুরস্কার গ্রহণ করার সময়।
অভিনেত্রী শবনম । ছবিঃ সংগৃহীত
তার প্রকৃত নাম ঝর্ণা বসাক। জন্ম ১৯৪০ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায়। যেই রুপালি জগতের জন্যে তিনি ঝর্ণা থেকে শবনাম হয়েছিলেন, সেই রুপালি জগৎই তার ব্যক্তিগত জীবনে নিয়ে আসে চরম বিপর্যয়।
অনেকেরই হয়ত জানা নেই বাংলাদেশী সিনেমায় “আম্মাজান”খ্যাত আভিনেত্রীর ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক ঘটনার।
দিনটা ১৯৭৮ সালের ১৩ মে । স্থান পাকিস্তানের লাহোরের অভিজাত এলাকা গুলবার্গ। পাকিস্তানের সমকালীন পত্র পত্রিকার বরাতে জানা যায়, সেদিন ৭ জন বন্দুকধারী পুরুষ আভিনেত্রী শবনমের বাসায় জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে। নগদ এক লক্ষ টাকা ও অলঙ্কার লুটপাটের পর তারা অভিনেত্রী শবনমকে তার সুরকার স্বামী প্রয়াত রবিন ঘোষ ও নয় বছরের ছেলে রনি ঘোষের উপস্থিতিতে গণধর্ষণ করে।
বলা হয়ে থাকে আসামিরা শবনমকে তার পেশার জন্যই নিজেদের শিকার হিসেবে বেছে নিয়েছিল। তখনকার পাকিস্তানের ক্রাইম রিপোর্টার জামীল চিশতী এর মতে, “তখন ‘মার্শাল ল’ এর সময় ছিল। আসামিরা এতটাই নির্ভীক ছিল যে তারা এর পরিণামের কথা ভেবেও দেখেনি। তার ভাষ্যমতে, অভিজুক্ত আসামীদের প্রভাবে তখন স্থানীয় পুলিশ এই মামলায় শুধুমাত্র চুরি ও লুটপাটের মামলাই দায়ের করে। পুলিশ তখন “গণ ধর্ষণ” এর জন্য মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
মামলায় অভিযুক্ত আসামীরা ছিলেন মোহাম্মদ ফারুক বান্দায়াল, ওয়াসিম ইয়াকুব ভাট, জামিল আহমেদ, তাহির তানভীর, জামশেদ আকবর সাহি, আঘা আকীল আহমেদ, মোহাম্মেদ মুযাফফার। অভিযুক্ত আসামীরা সবাই প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান ছিলেন।তখনকার সময়ে স্পেশাল মিলিটারি কোর্টে আভিজুক্তদের নিয়ে বিচার
বসে।অভিজুক্তদের মধ্যে ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড তখনকার পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ জিয়া উল হক নিজে নির্ধারণ করেছিলেন। পরে পাকিস্তানের প্রখ্যাত আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী এস .এম . জাফরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ জিয়া উল হককে লেখা চিঠির বদৌলতে তাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়।
পরিবারের সাথে অভিনেত্রী শবনম । ছবিঃ সংগৃহীত
পাকিস্তানের বিভিন্ন সাংবাদ মাধ্যমের মতে,ঘটনার পর থেকেই আভিনেত্রী শবনম তার একমাত্র ছেলে রনি ঘোষের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন। তিনি প্রথমে তার সন্তানের সুরক্ষার জন্য অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী রাখলেও পরে তার সন্তানকে তিনি লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা সবাই প্রভাবশালী পরিবারের হওয়ায় তিনি বিভিন্ন সময় মামলা থেকে পিছে সরে আসার জন্য হুমকি পেতেন।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা মুক্তি পাওয়ার পর তার নিজের সন্তানের জন্য ভীতি আরও বাড়তে থাকে। ১৯৯৭ সালে তিনি সাংবাদিক শাহেদ নাসের চৌধুরী এর সাথে শাহনূর স্টুডিয়োতে তার শেষ উর্দু ছবি “আউলাদ কি কসম” এর শুটিংয়ের সময় তাকে বলেন, "আমি নিজের একমাত্র সন্তানের সুরক্ষার কথা সবসময় চিন্তা করি। আমার পক্ষে এই ভয়ে এই দেশে থাকাটা আর সম্ভব নয়।"
তিনি এর পরে ঢাকায় চলে আসেন। অভিনয় করেন তার জীবনের শেষ ছবিতে যার নাম 'আম্মাজান'। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। যেই মাতৃত্বের জন্য তিনি তার কষ্টের গড়া অভিনয় জীবন ছেড়ে ঢাকায় চলে এলেন সেই মাতৃত্বের উপর নির্ভর করে নির্মিত ছবি 'আম্মাজান'ই তাকে বাংলা সিনেমায় অমর করে রেখেছে।
আমরা হয়ত এটা অনেক সময় আনুধাবন করতে পারিনা যে মাতৃত্বের ত্যাগ মাত্র নয় মাস সন্তানকে পেটে ধারণ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনা, এর বাইরেও মায়েরা তাদের সন্তানদের মঙ্গলের জন্য সারাজীবন অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে থাকেন, যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রুপালি পর্দার অভিনেত্রী শবনম । তিনি কতটা নিষ্ঠার সাথে তার বাস্তব জীবনে মায়ের চরিত্র পালন করেছেন তা হয়ত তার অনেক আনুরাগী্র দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যাবে।
-লেখক মোঃ অলিউর রহমান-