মেলবন্ধন ঘটেছে বাংলা ও ফারসি
সম্প্রতি কোক স্টুডিও বাংলার তৃতীয় সিজনে প্রকাশ্যে এসেছে ‘মহা জাদু’ শিরোনামের একটি গান। গানটি এই সিজনের ষষ্ঠ গান। গানটিতে বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী হাবিব ওয়াহিদ ও তাজিকিস্তানের শিল্পী মেহেরনিগর রুস্তম কণ্ঠ দিয়েছেন। এই গানে মেলবন্ধন ঘটেছে বাংলা ও ফারসি ভাষার। গানটির বদৌলতে উঠে এসেছে বাউল খোয়াজ মিয়া ও তার জীবন দর্শন।
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংগীতপ্রেমীদের মাঝে চলছে ব্যাপক আলোচনা। মহা জাদু গানটির মূল গীতিকার বাংলাদেশের বাউল খোয়াজ মিয়া। গানের ফারসি অংশের গীতিকার হাদিস দেহঘান। এই দুই ভাষার মিশ্রণে কোক স্টুডিও বাংলা বানিয়েছে গানটি।
ঐতিহ্যবাহী লোকগীতির সাথে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের এই মেলবন্ধন বাউল খোয়াজ মিয়া ও তার দর্শনকেও নতুন প্রজন্মের কাছে হাজির করেছে।
বাউল খোয়াজ মিয়া
বাউল খোয়াজ মিয়া ১৯৪২ সালের ১২ই মার্চ সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা মরমী সাহিত্যের এক নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ কবি ও সাধক। খোয়াজ মিয়া বাউল গান ও সুফিবাদের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে শত শত আধ্যাত্মিক গান রচনা করেছেন।
তার জন্মস্থান সম্পর্কে তিনি নিজেই তার গানের মাধ্যমে পরিচয় তুলে ধরেছেন, যা তার ভৌগোলিক শেকড়ের প্রতি গভীর মমত্ববোধের পরিচায়ক। তিনি গেয়েছেন, ‘দৌলতপুর ইউ পি, পোস্ট অফিস ঠিকানাতে লেখি, ঐ গেরামে জন্ম আমার, ঐ গেরামে থাকি।’
খোয়াজ মিয়া সংগীতের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন শৈশব থেকেই। তথাকথিত পড়াশোনা তাকে টানতো না বরং বাঁশি বাজানো এবং গান গাওয়াই ছিলো তার হৃদয়ের কাছে। গানের প্রতি তার এই গভীর অনুরাগ তার পরিবার ও সমাজের সাথে এক সংঘাত তৈরি করে। কারণ তার পিতা একজন মৌলভী। ফলে বাড়িতে বাদ্যযন্ত্র বা গান-বাজনা ছিল নিষিদ্ধ। পরিবারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, তিনি গোপনে বিভিন্ন গ্রামে গানের আসরে ছুটে যেতেন। খোয়াজ মিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মাত্র তৃতীয় শ্রেণিতেই শেষ হয়।
জানা যায়, ১৯৬২ সালে ২২ বছর বয়সে খোয়াজ মিয়া আধ্যাত্মিক গুরুর সন্ধানে বাড়ি ছাড়েন। তারপরেই তার জীবনের মোড় ঘুরে দেয় এবং তার আনুষ্ঠানিক সাধনার সূচনা করে। এই সময়েই তার গানের বিষয়বস্তু বিনোদন থেকে আধ্যাত্মিক ও মানবতাবাদী দর্শনের দিকে মোড় নেয় ।
ফকির দুরবিন শাহর শিষ্য খোয়াজ মিয়া
খোয়াজ মিয়া ‘জ্ঞানের সাগর’ নামে খ্যাত প্রখ্যাত মরমি সাধক ফকির দুরবিন শাহর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। গুরু দুরবিন শাহর সান্নিধ্যে আসার পর তিনি একনিষ্ঠভাবে তার সাধনায় মগ্ন হন এবং গানের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক দর্শন ও মানবতাবাদী বার্তা ছড়িয়ে দিতে নিজেকে উৎসর্গ করেন। গুরুর আদেশ ও নিয়মকানুন শ্রদ্ধার সাথে পালন করে তিনি পরমাত্মার অন্বেষণ এবং আত্মমুক্তির কৌশল আয়ত্ত করেন ।
খোয়াজ মিয়া একই দিনে ফকির দুরবিন শাহর শিষ্যত্ব গ্রহণের পাশাপাশি সাধক ফকির ‘ছাবাল শাহ’-এর কাছেও ‘বায়াত’ (আধ্যাত্মিক আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করেন। তার গানে তিনি কামিল মুর্শিদের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন (“কামিল মুর্শিদ সাত রাজার ধন ভজলে মিলে পরশ রতন করলে সাধন হয় মহাজন চৌদ্দ পুরুষ স্বর্গে যায়”)।
গত ২৬ জুন মারা গেছেন বাউল খোয়াজ মিয়া। ‘মহা জাদু’ গানটি তাকে আধুনিক সংগীতে মরণোত্তর জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। লেখক ও গবেষক গৌতম কে শুভর নেওয়া সাক্ষাৎকারে খোয়াজ মিয়া জানিয়েছিলেন, ‘গানটা লেখা হয়েছে ১৯৬৮ সালের দিকে। তখন আমি আত্ম-অনুসন্ধান করছিলাম।’
খোয়াজ মিয়ার জীবনী বই
বাউল খোয়াজ মিয়া ও তার জীবন দর্শন ও গান নিয়ে বই লিখেছেন সৈয়দা আঁখি হক। বইটির নাম খোয়াজ মিয়াঃ জীবনকথা ও গীতিসমগ্র। বইটি ‘সময় প্রকাশন’ থেকে প্রকাশ হয়েছে ২০১৯ সালে। খোয়াজ মিয়াকে নিয়ে আঁখি বলেন, ‘খোয়াজ মিয়া মূলত আধ্যাত্মবাদের ওপর ভর করে গান লেখেন। এই গানটিও তা-ই। তার মুর্শিদের প্রেমে তিনি পাগল গানে উপমা হিসেবে তিনি অনেক অনুষঙ্গ এনেছেন। সেগুলো দেখে মনে হতে পারে, এটা প্রেমের গান। এখানে প্রেমিকার প্রতি নিবেদন বা প্রেমিকার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু মুর্শিদের মধ্য দিয়ে তিনি তার স্রষ্টাকে চেয়েছেন। গানে সেই কথাই এসেছে উপমা হিসেবে।’
খোয়াজ মিয়া রচিত আরও জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে, ‘আমার ভয় লাগিল মনেরে, ভয় লাগিল মনে, আমায় কোনদিন ধরিয়া নিব যম’, ‘যাইও না যাইও না কন্যাগো, কইন্যা যাইও না নাইওর, তুমি বিনে কেমনে থাকি একেলা বাসর কন্যাগো’, ‘ভুবন-মোহন রূপ তোমারই, দেখলে প্রাণ জুড়ায়, আমার বাড়ি আয়রে বন্ধু, আমার বাড়ি আয়’ প্রভৃতি।