ঢালিউডের রূপান্তর
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প, বা যাকে আমরা ভালোবেসে “ঢালিউড” বলি, সেটি কেবল বিনোদনের একটি মাধ্যম নয় এটি আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। গত ছয় দশকে ঢালিউড অসংখ্য উত্থান পতন, সামাজিক পরিবর্তন ও প্রযুক্তিগত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে। ১৯৬০ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত ঢালিউডের রূপান্তর এর গল্প, শিল্প, সমাজ ও প্রযুক্তির বদলে যাওয়া ছয় দশকের যাত্রা। “মুখ ও মুখোশ” থেকে “বরবাদ” পর্যন্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস, সংগ্রাম ও সাফল্যের এক সাংস্কৃতিক দলিল।
এই প্রবন্ধে আমরা ১৯৬০ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত ঢালিউডের বিবর্তন, প্রভাব, সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব ,যেন বোঝা যায় কীভাবে এক বিনোদন শিল্প আজ একটি জাতির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
ঢালিউডের রূপান্তর- ১৯৫০–৬০ দশক : আলোছায়ার প্রথম পদক্ষেপ
১৯৫৬ সালে ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিটি বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম সবাক চলচ্চিত্র হিসেবে মুক্তি পায়, যা ছিল এই শিল্পের একটি যুগান্তকারী ঘটনা। আব্দুল জব্বার খান এই ছবির পরিচালক ছিলেন এবং তাঁকে বাংলা চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র, এবং এর মাধ্যমেই ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণের নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
সামাজিক বাস্তবতার গল্প
৬০ এর দশকে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো মূলত গ্রামীণ জীবন, সামাজিক বন্ধন ও পারিবারিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটায়। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র “রূপবান” (১৯৬৫), যা জাত্রা সংস্কৃতির প্রভাব নিয়ে নির্মিত হয়ে বাণিজ্যিকভাবে বিশাল সাফল্য পায়।
তখন সিনেমা ছিল একধরনের পারিবারিক উৎসব। পরিবার, প্রেম, সম্পর্ক, আত্মত্যাগ, এসব বিষয় নিয়েই গড়ে উঠত কাহিনি। সেই সময়কার সিনেমার নির্মাতারা সীমিত প্রযুক্তি ও কম বাজেটে অসাধারণ সৃজনশীলতা দেখিয়েছিলেন।
‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০) – বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীকী চলচ্চিত্র
১৯৭০ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিপ্রাপ্ত “জীবন থেকে নেয়া” বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। এটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনাকে পরোক্ষভাবে ফুটিয়ে তোলে।
পরিচালক: জহির রায়হান
মুক্তির সাল: ১৯৭০
মুক্তির তারিখ: ১০ এপ্রিল ১৯৭০
এই চলচ্চিত্রটি মূলত একটি পরিবারের গল্পের মাধ্যমে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরে। “জীবন থেকে নেয়া” শুধু একটি সিনেমা নয় , এটি ছিল একটি জাতীয় আন্দোলনের প্রতিধ্বনি, যা দর্শকদের মনে দেশপ্রেম ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে “জীবন থেকে নেয়া” এখনো অন্যতম রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী সিনেমা, যা জাতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত এবং আজও প্রাসঙ্গিক।
ঢালিউডের রূপান্তর – স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্রের বিকাশ: ১৯৭১–১৯৯১ এবং পরবর্তী ধারা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে নতুন এক চলচ্চিত্র সংস্কৃতির জন্ম হয়। ১৯৭১ থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত সময়টা ছিল একদিকে সংগ্রামের, অন্যদিকে সৃজনশীল বিকাশের।
এই দুই দশকেরও বেশি সময় জুড়ে চলচ্চিত্র নির্মাতারা সমাজ, মানবতা ও বাস্তবতার গল্পকে নতুনভাবে পর্দায় তুলেছেন।
স্বাধীনতার বছর: ১৯৭১ – যুদ্ধের ছায়ায় সিনেমা
স্বাধীনতার বছর ১৯৭১ সালে দেশে মোট আটটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়।
যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও নির্মাতারা কাজ চালিয়ে গেছেন।
এই সময়ের উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে :
- নজরুল ইসলামের “স্বরলিপি”,
- অশোক ঘোষের “নাচের পুতুল”,
- আলমগীর কুমকুমের “স্মৃতিটুকু থাক”,
- খান আতাউর রহমানের “সুখ দুঃখ”।
এগুলো মূলত সামাজিক বাস্তবতা ও মানবিক সম্পর্কের গল্পে নির্মিত।
দেশ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত, কিন্তু শিল্পীরা বিশ্বাস করেছিলেন চলচ্চিত্রই মানুষকে আশা দেখাতে পারে।
ঢালিউডের রূপান্তর – ১৯৭২–১৯৭৫: পুনর্গঠন ও সৃজনশীলতার উত্থান
স্বাধীনতার পর দেশের চলচ্চিত্রে শুরু হয় নবযাত্রা।
১৯৭২ সালে আলমগীর কবিরের “ধীরে বহে মেঘনা”, জহিরুল হকের “রংবাজ”, সুভাষ দত্তের “বলাকা মন”, এবং ঋত্বিক ঘটকের “তিতাস একটি নদীর নাম” বাংলা চলচ্চিত্রকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।
এই ধারায় ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার “আলোর মিছিল” মুক্তি পেয়ে সাড়া ফেলে।
পরের বছর, ১৯৭৫ সালে তাঁর “লাঠিয়াল” ও খান আতাউর রহমানের “সুজন সখী” চলচ্চিত্রও দর্শকের মন জয় করে নেয়।
এই সময়ের চলচ্চিত্রগুলোয় দেশ, প্রেম, মানবতা ও সামাজিক পুনর্গঠনের বার্তা প্রবলভাবে প্রকাশ পায়।
ঢালিউডের রূপান্তর – ১৯৭৬–১৯৭৯: চলচ্চিত্রে শিল্পবোধ ও আন্তর্জাতিক ছোঁয়া
১৯৭৬ সাল ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়।
এই বছর নির্মিত কয়েকটি সিনেমা পুরো শিল্পের ধারণাকেই বদলে দেয় ,
- রাজেন তরফদারের “পালঙ্ক”,
- হারুনর রশীদের “মেঘের অনেক রঙ”,
- আলমগীর কবিরের “সূর্য কন্যা”,
- কবীর আনোয়ারের “সুপ্রভাত”,
- আবদুস সামাদের “সূর্যগ্রহণ”,
- আমজাদ হোসেনের “নয়নমণি”।
এই ছবিগুলো শুধুই বিনোদন নয়; এগুলো সমাজ, শ্রেণিবিন্যাস ও মানুষের মানসিক গভীরতা নিয়ে কাজ করেছে।
এরপর ১৯৭৭ সালে আলমগীর কবিরের “সীমানা পেরিয়ে” এবং সুভাষ দত্তের “বসুন্ধরা” শিল্পমান ও সৌন্দর্যে দর্শকদের মুগ্ধ করে।
১৯৭৮ সালে আসে আমজাদ হোসেনের “গোলাপী এখন ট্রেনে” ও আবদুল্লাহ আল মামুনের “সারেং বৌ” দুটোই সময়ের সেরা সামাজিক চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত।
১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়।
মসিউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলীর যৌথ পরিচালনায় “সূর্য দীঘল বাড়ি” মুক্তি পেয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্র অঙ্গনে বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচয় করায়।
একই বছরে আলমগীর কবিরের “রূপালী সৈকত” সমালোচক ও দর্শক উভয়ের প্রশংসা পায়।
ঢালিউডের রূপান্তর – ১৯৮০–১৯৮৫: বাস্তবতা, সমাজ ও দর্শকপ্রিয়তার যুগ
আশির দশকের শুরুতে চলচ্চিত্র আরও পরিণত হয়।
১৯৮০ সালে আমজাদ হোসেনের “কসাই” এবং দিলীপ সোমের “স্মৃতি তুমি বেদনা” ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে।
এরপর “জন্ম থেকে জ্বলছি” (১৯৮১) আমজাদ হোসেনের এক অনন্য সৃষ্টি, যা সুস্থধারার গল্পকে এগিয়ে নেয়।
১৯৮২ সালে নির্মিত কয়েকটি ছবিকে ধরা হয় সেই দশকের মানদণ্ড নির্ধারক হিসেবে ,
চাষী নজরুল ইসলামের “দেবদাস”,
মোস্তফা আনোয়ারের “কাজল লতা”,
আবদুস সামাদ খোকনের “বড় বাড়ির মেয়ে”,
মতিন রহমানের “লাল কাজল”,
আলমগীর কবিরের “মোহনা”।
এই সিনেমাগুলো সমাজ, প্রেম, এবং নৈতিক মূল্যবোধকে একই সূত্রে বেঁধেছে।
১৯৮৩ সালে সিবি জামানের “পুরস্কার”, এজে মিন্টুর “মান সম্মান” ও সুভাষ দত্তের “নাজমা” ধারাবাহিকভাবে সফল হয়।
১৯৮৪ সালে মুক্তি পায় একাধিক সফল চলচ্চিত্র ,
আখতারুজ্জামানের “প্রিন্সেস টিনা খান”,
কাজী হায়াতের “রাজবাড়ি”,
চাষী নজরুল ইসলামের “চন্দ্রনাথ”,
আমজাদ হোসেনের “সখিনার যুদ্ধ” এবং “ভাত দে”।
এই সময়ের চলচ্চিত্রে মানবিকতা, সমাজচেতনা এবং রাজনীতির প্রভাব একত্রে মিশে যায়।
১৯৮৫ সালে মুক্তি পায় শক্তি সামন্ত ও সৈয়দ হাসান ইমামের “অবিচার”, শেখ নিয়ামত আলীর “দহন”, রাজ্জাকের “সৎ ভাই”, এবং শহিদুল আমিনের “রামের সুমতি” যা আশির দশকের মধ্যভাগে ঢালিউডের দিকনির্দেশনা স্থির করে দেয়।
ঢালিউডের রূপান্তর- ১৯৮৬–১৯৯১: সাহিত্যের ছোঁয়া ও নতুন ধারার সূচনা
আশির দশকের শেষার্ধে সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রে ঢালিউড নতুন মাত্রা পায়।
১৯৮৬ সালে সুভাষ দত্তের “ফুলশয্যা”, আলমগীর কবিরের “পরিণীতা”, চাষী নজরুল ইসলামের “শুভদা”,
বুলবুল আহমেদের “রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত”,
নারায়ণ ঘোষ মিতার “হারানো সুর”,
আফতাব খান টুলুর “দায়ী কে”,
কবীর আনোয়ারের “তোলপাড়”,
এবং মহিউদ্দিন ফারুকের “বিরাজবৌ” সবই ছিল শিল্পগুণে পরিপূর্ণ।
নব্বই দশকের শুরুতে সৈয়দ সালাহ্উদ্দিন জাকীর “আয়না বিবির পালা” (১৯৯১) এবং এহতেশামের “চাঁদনী” (১৯৯১) চলচ্চিত্র দুটি নতুন প্রজন্মের দর্শকের কাছে জনপ্রিয়তা পায়।
এই সময় থেকে ঢালিউডে বাণিজ্যিকতার পাশাপাশি বাস্তবধর্মী ও চিন্তাশীল গল্প বলার প্রবণতা বাড়ে।
স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্রে মানবিক ধারা
স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শুধু বিনোদন নয় এটি হয়ে ওঠে একটি সামাজিক দলিল।
চাষী নজরুল ইসলামের “হাসন রাজা”, তানভীর মোকাম্মেলের “লালন” (২০০৪),
মোরশেদুল ইসলামের “দুখাই” ও “লালসালু”,
আখতারুজ্জামানের “পোকামাকড়ের ঘরবসতি”,
তারেক মাসুদের “মাটির ময়না” (২০০২),
এবং কাজী মোরশেদের “ঘানি” (২০০৮)
এসব চলচ্চিত্র প্রমাণ করে, শিল্প যদি সমাজের ভেতরের গল্প বলতে পারে, তবে সেটিই চিরকাল বেঁচে থাকে।
এই চলচ্চিত্রগুলো শুধু সমালোচকদের প্রশংসাই অর্জন করেনি, বরং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে।
মানবিক বোধ, নৈতিকতা, ইতিহাস ও সমাজচেতনা, এই চার উপাদান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্বমানের শিল্পে পরিণত করেছে।
বাণিজ্যিক সাফল্যের যুগ
৮০ এর দশক ছিল ঢালিউডের তথাকথিত “স্বর্ণযুগ”। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র তখন মানুষের জীবনের অন্যতম বিনোদন উৎস হয়ে ওঠে।
“বেদের মেয়ে জোসনা” (১৯৮৯) সেই সময়ের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করে। রাজ্জাক, আলমগীর, জসিম, শাবানা, কবরী প্রমুখ ছিলেন এই সময়ের কিংবদন্তি তারকা।
চলচ্চিত্রে গানের ব্যবহার, নাচ, নাটকীয় ক্লাইম্যাক্স, এবং পরিবারভিত্তিক গল্প দর্শককে হলে টেনে আনত।
ঢালিউডের রূপান্তর – বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্রের বিকাশ :
সময়কাল | প্রধান বৈশিষ্ট্য | উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র | নির্মাতা / পরিচালক | বিশেষ মন্তব্য |
---|---|---|---|---|
১৯৭১ | যুদ্ধকালীন সময়েও চলচ্চিত্র নির্মাণ অব্যাহত; মানবিক গল্পে ফোকাস | স্বরলিপি, নাচের পুতুল, স্মৃতিটুকু থাক, সুখ দুঃখ | নজরুল ইসলাম, অশোক ঘোষ, আলমগীর কুমকুম, খান আতাউর রহমান | যুদ্ধের ছায়াতেও চলচ্চিত্র আশা ও মানবতার প্রতীক হয়ে ওঠে |
১৯৭২–১৯৭৫ | স্বাধীনতার পর পুনর্গঠন ও সৃজনশীল জাগরণ | ধীরে বহে মেঘনা, রংবাজ, বলাকা মন, তিতাস একটি নদীর নাম, আলোর মিছিল, লাঠিয়াল, সুজন সখী | আলমগীর কবির, জহিরুল হক, সুভাষ দত্ত, ঋত্বিক ঘটক, নারায়ণ ঘোষ মিতা, খান আতা | দেশ, প্রেম ও মানবতার থিমে নতুন ধারার সূচনা |
১৯৭৬–১৯৭৯ | শিল্পবোধ, বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টি | পালঙ্ক, মেঘের অনেক রঙ, সূর্য কন্যা, নয়নমণি, সূর্য দীঘল বাড়ি, রূপালী সৈকত | রাজেন তরফদার, হারুনর রশীদ, আলমগীর কবির, আমজাদ হোসেন, মসিউদ্দিন শাকের, শেখ নিয়ামত আলী | বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যালে স্বীকৃতি পায় |
১৯৮০–১৯৮৫ | বাস্তবতা ও সমাজধর্মী গল্পের বিকাশ | কসাই, স্মৃতি তুমি বেদনা, জন্ম থেকে জ্বলছি, দেবদাস, কাজল লতা, লাল কাজল, চন্দ্রনাথ, ভাত দে | আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল ইসলাম, মতিন রহমান, মোস্তফা আনোয়ার, সুভাষ দত্ত | সমাজচেতনা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির উত্থান |
১৯৮৬–১৯৯১ | সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র ও নতুন ধারার সূচনা | ফুলশয্যা, পরিণীতা, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, হারানো সুর, আয়না বিবির পালা, চাঁদনী | সুভাষ দত্ত, আলমগীর কবির, বুলবুল আহমেদ, নারায়ণ ঘোষ মিতা, সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী, এহতেশাম | সাহিত্য ও বাস্তবতার মিশ্রণে নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্র |
৮০-এর দশকের স্বর্ণযুগ | বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের উত্থান ও তারকাখ্যাতি | বেদের মেয়ে জোসনা, সখিনার যুদ্ধ, ভাত দে, অবিচার | আমজাদ হোসেন, সৈয়দ হাসান ইমাম, রাজ্জাক, চাষী নজরুল ইসলাম | ঢালিউডের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শিখর |
পরবর্তী মানবিক ধারা (২০০০–২০০৮) | সমাজ, ধর্ম ও নৈতিকতা কেন্দ্রিক গল্প | হাসন রাজা, লালন, দুখাই, লালসালু, পোকামাকড়ের ঘরবসতি, মাটির ময়না, ঘানি | চাষী নজরুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম, তারেক মাসুদ, কাজী মোরশেদ | আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও মানবিক গল্প বলার পুনর্জাগরণ |
ঢালিউডের রূপান্তর (১৯৯০–১৯৯৯): ভিডিও যুগ, স্যাটেলাইট টিভি ও নতুন ভাবনা
ভিডিও ক্যাসেট থেকে ঘরে বসে সিনেমা
৯০–এর দশকে VHS/VCR ছড়িয়ে পড়ায় দর্শক প্রথমবার ঘরে বসে বাংলা ও বিদেশি সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা পান। কেবল টিভি ঢুকে পড়ায় বিদেশি কন্টেন্ট রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ঘরে পৌঁছে যায় ফলে হল নির্ভরতা কমে, আর বাজারের খেলা বদলে যায়। এটি একদিকে প্রচারে “বিপ্লব”, অন্যদিকে স্থানীয় সিনেমার জন্য ভয়াবহ প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করে।
পাইরেসির ধাক্কা: হলমুখী বাজারে আঘাত
ভিডিও/VCD–পাইরেসি ছড়িয়ে পড়ায় একই দিনে বাজারে কপি পৌঁছে যেত , হলমালিকদের ঝুঁকি বাড়ত, আয় কমত। পরের দুই দশকে এই চাপে দেশের সিনেমা হল কমতে থাকে ৯০ এর দশকে হাজারের বেশি হল থাকলেও পরে সংখ্যা কয়েকশ’তে নেমে আসে এবং সাম্প্রতিক আলোচনায় ৬০–৭০ এর মতো সক্রিয় হলের হিসাবও উঠে এসেছে। প্রবণতার সূচনা ৯০ এর দশকেই, যখন পাইরেসি নিয়ে খোলাখুলি অভিযোগ শুরু হয়। Daily Observer+3Dhaka Tribune+3Dhaka Tribune+3
স্যাটেলাইট টিভির আগমন: দর্শকের মনোযোগ বিভাজন
বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চালুর ফলে (ATN Bangla ১৫ জুলাই ১৯৯৭; Channel i ১ অক্টোবর ১৯৯৯) দর্শকের চোখের বড় অংশ টিভি কনটেন্টে সরে যায় ড্রামা, মিউজিক শো, বিদেশি চ্যানেল ইত্যাদি। এই “টিভি রেভল্যুশন” সিনেমা হলের জন্য ছিল নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
হলের পতন গাথা: হাজার থেকে কয়েক ডজন
প্রদর্শক সমিতি ও গণমাধ্যম রিপোর্টে দেখা যায় ৯০ এর শুরুতে দেশের হল ছিল এক হাজারেরও বেশি; ২০০০ এর দশক পেরোতে পেরোতেই সক্রিয় হল শতকের ঘরে, সাম্প্রতিক বছরে অনেকে “৬০–১০০” এর মতো সংখ্যাও উল্লেখ করছেন। প্রবণতার সূচনা ৯০ এর দশকেই, যখন কেবল/ভিডিও যুগ ও পাইরেসি নিয়ম বদলে দেয়। Business Inspection BD+2The Daily Star+2
নতুন ধারার নির্মাণ: কেবল বিনোদন নয়, সমাজ–বাস্তবতা
৯০–এর ছবিতে রাজনৈতিক দুর্নীতি, দারিদ্র্য, নারী স্বাধীনতা, গ্রামীণ জীবনের সংগ্রাম উঠে আসে। উদাহরণ হিসেবে মোরশেদুল ইসলাম এর দুখাই (১৯৯৭) কৃষিজীবনের দুর্দশা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কেন্দ্র করে নির্মিত এটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে নয়টি বিভাগে পুরস্কার পায়। Wikipedia+1
মধ্যবিত্তের ফিরে আসা: যুদ্ধ–স্মৃতি ও পারিবারিক আবেগ
হুমায়ূন আহমেদ–এর আগুনের পরশমণি (১৯৯৪) মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে জনপ্রিয় ভাষায় ফিরিয়ে আনে এবং Best Feature সহ বহু বিভাগে জাতীয় পুরস্কার জেতে নব্বইয়ের মাঝামাঝিতে “বাংলা ছবি” থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা মধ্যবিত্ত দর্শকও হলে ফেরে। Wikipedia+1
তারকা যুগ ও রিমেক–তরঙ্গ
সালমান শাহ , মৌসুমী কে পরিচিত করে দেওয়া কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩) ছিল ব্যাপক সফল; এটি হিন্দি QSQT এর অফিসিয়াল রিমেক রিমেক/অ্যাডাপ্টেশনের ধারা নব্বইয়ে জনপ্রিয় হয় এবং বাজারে নতুন ঢেউ তোলে। একই সঙ্গে রোমান্টিক গান, স্টার পাওয়ার সব মিলে দর্শক appeal তীব্র হয়। Wikipedia+1
যৌথ প্রযোজনা ও টিভি থেকে থিয়েটার: নতুন পরীক্ষার পথ
হঠাৎ বৃষ্টি (১৯৯৮) বাংলাদেশ ভারতের যৌথ প্রযোজনা প্রথমে টিভিতে প্রচার, পরে থিয়েট্রিকাল রিলিজে বক্স অফিস সাফল্য এই ফরম্যাট নব্বইয়ের শেষভাগে নতুন পথ দেখায়; পরবর্তী যৌথ প্রযোজনার ধারার প্রাথমিক সংকেতও এখানেই। The Daily Star+1
দশকের শেষের আইকন
নব্বইয়ের “ঢালিউডের সোনালি নব্বই” এর জনপ্রিয় মুখ মন্না অভিনীত আম্মাজান (১৯৯৯) কাল্ট স্ট্যাটাস পায় বাণিজ্যে ও সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে এটি দশকের অন্যতম প্রতীক। Wikipedia
কেন ১৯৯০ এর দশক ‘ঢালিউডের সোনালি সময়’ ?
১৯৯০-এর দশক ছিল এমন এক সময়, যখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প একযোগে সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েছিল তবু টিকে থেকেছে, নিজস্ব ভাষা ও দর্শকশ্রেণি ধরে রেখেছে। এই দশককে ‘সোনালি’ বলা হয় কারণ এটি ছিল পরিবর্তনের ভিত গড়ে তোলার যুগ।
টেক–শিফট সামলে টিকে থাকা
ভিডিও ক্যাসেট (VHS), কেবল নেটওয়ার্ক এবং স্যাটেলাইট টিভির আবির্ভাবে চলচ্চিত্র শিল্পে ভয়াবহ ধাক্কা আসে। দর্শক হলে না গিয়ে ঘরে বসেই সিনেমা দেখতে শুরু করেন। তবুও ঢালিউড এই টেক–শিফটের মাঝেও ধারাবাহিকভাবে জনপ্রিয় ছবি উপহার দিতে থাকে কেয়ামত থেকে কেয়ামত, তুমি আমার, আম্মাজান বা আগুনের পরশমণি , সবই প্রমাণ করে যে দর্শকের রুচি বদলেও বাংলা সিনেমা নিজের ধারা ও ভাষা ধরে রেখেছিল। (সূত্র: New Age, The Daily Star, Wikipedia)
কনটেন্ট বৈচিত্র্য ও নতুন ভাবনা
এই দশকেই সিনেমায় নতুন সামাজিক বাস্তবতা জায়গা করে নেয়।
হুমায়ূন আহমেদের আগুনের পরশমণি (১৯৯৪) মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে জনমনে ফিরিয়ে আনে,
মোরশেদুল ইসলামের দুখাই (১৯৯৭) গ্রামীণ জীবনের কষ্ট ও দুর্যোগকে সামনে আনে,
আর কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩) আধুনিক প্রেমের নতুন ধারা গড়ে তোলে।
এই বৈচিত্র্যই ঢালিউডকে একাধারে চিন্তাশীল ও বাণিজ্যিক দুই ধারার দর্শকের মন জয় করতে সাহায্য করেছে। (সূত্র: Wikipedia, National Film Award Archive)
ভবিষ্যতের প্রস্তুতি
পাইরেসি, হল পতন, ও দর্শক হারানোর অভিজ্ঞতা চলচ্চিত্রশিল্পকে কঠিন শিক্ষা দেয়।
এর ফলে প্রযোজক ও পরিচালকেরা বুঝতে পারেন সময় বদলেছে, বিতরণ ও প্রযোজনার ধরনও বদলাতে হবে।
এই উপলব্ধি থেকেই ২০০০ এর দশকে মাল্টিপ্লেক্স সংস্কৃতি, ডিজিটাল ডিস্ট্রিবিউশন, যৌথ প্রযোজনা এবং পরবর্তীতে OTT প্ল্যাটফর্মের পথ উন্মুক্ত হয়।
অর্থাৎ, ৯০ এর দশকই ছিল আজকের ডিজিটাল চলচ্চিত্র যুগের বীজ রোপণের সময়। (সূত্র: New Age, Dhaka Tribune)
সংক্ষেপে, নব্বইয়ের ঢালিউড ছিল এমন এক যুগ, যেখানে সংকট, প্রযুক্তি, প্রতিযোগিতা, এবং সৃজনশীলতা মিলেমিশে এক নতুন অধ্যায় তৈরি করেছিল। এই কারণেই চলচ্চিত্র গবেষক ও ইতিহাসবিদরা একে বলেন :
“ঢালিউডের সোনালি নব্বই (The Golden Nineties of Dhallywood)।”
(রেফারেন্স: National Film Award Archive, Wikipedia – List of Bangladeshi Films by Year, New Age, The Daily Star Feature Archives)
২০০০ ও ২০১০ দশক: ডিজিটাল বিপ্লব ও বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের পদচারণা
ঢালিউডের রূপান্তর: ডিজিটাল প্রযুক্তির আগমন
২০০০ সালের পর থেকে সিনেমা নির্মাণে ডিজিটাল প্রযুক্তি ঢুকে যায়। ক্যামেরা, এডিটিং, সাউন্ড ও গ্রাফিক্সে আসে আধুনিকায়ন। এতে খরচ কমে যায়, নির্মাতার স্বাধীনতা বাড়ে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: “মাটির ময়না” থেকে “বাড়ির নাম শাহানা”
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প এখন আর কেবল দেশীয় বিনোদনের সীমায় নেই , এটি আজ একটি আন্তর্জাতিক আলোচ্য বিষয়।
২০০২ সালে “মাটির ময়না” দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা ২০২৫ সালে এসে “বাড়ির নাম শাহানা”, “Ali”, “Borbaad” ও “NeelChokro” র মতো চলচ্চিত্রে নতুন গৌরবে পৌঁছেছে।
২০০২: “মাটির ময়না” আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সূচনা
প্রয়াত নির্মাতা তারেক মাসুদ পরিচালিত “মাটির ময়না” বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করে।
এই চলচ্চিত্রটি কান চলচ্চিত্র উৎসবের (Cannes Film Festival) Directors’ Fortnight বিভাগে প্রদর্শিত হয়, যা ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রথম বিশ্বমঞ্চে সাফল্য।
“মাটির ময়না” ১৯৭০ এর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে নির্মিত এক মানবিক গল্প। চলচ্চিত্রটি ২০০৩ সালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো অস্কারের Best Foreign Language Film বিভাগে প্রেরণ করা হয়।
যদিও এটি চূড়ান্ত মনোনয়নে পৌঁছায়নি, তবুও এটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক স্থাপন করে।
ঢালিউডের রূপান্তর – ২০০৬–২০০৮: ধারাবাহিক অস্কার অংশগ্রহণের সূচনা
২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছরই অস্কারে একটি চলচ্চিত্র প্রেরণ করা শুরু করে।
প্রথম তিন বছরে নির্বাচিত চলচ্চিত্রগুলো ছিল :
- “শ্যামল ছায়া” (২০০৬) — হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধ ভিক্তিক মানবিক গল্প
- “নিরন্তর” (২০০৭) — আবু সাইয়িদের বাস্তবধর্মী নির্মাণ
- “স্বপ্নডানায়” (২০০৮) — গোলাম রাব্বানী বিপ্লবের সৃজনশীল উপস্থাপন
এই তিনটি চলচ্চিত্র অস্কারে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পেলেও, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য একটি স্থায়ী কাঠামো তৈরি করে দেয়।
ঢালিউডের রূপান্তর – ২০১০–২০১৮: আন্তর্জাতিক উৎসব ও নতুন ধারার উত্থান
২০১০ এর দশক থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিশ্বব্যাপী নতুন স্বীকৃতি পেতে শুরু করে।
কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ
- “গেরিলা” (২০১১) নাসিরউদ্দিন ইউসুফ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র; একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে।
- “টেলিভিশন” (২০১২) মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর গল্প, যা বার্লিন ও বুসান ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়।
- “উধাও” (২০১৩) অমিত আশরাফ পরিচালিত মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার; দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে নতুন দিগন্ত।
- “মেহেরজান” (২০১১) রুবাইয়াত হোসেনের নারী কেন্দ্রিক চলচ্চিত্র, যা দেশ বিদেশে আলোচিত হয়।
- “ডুব” (২০১৮) মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর আন্তর্জাতিক যৌথ প্রযোজনা; ইরফান খান অভিনীত ও বাংলাদেশের অস্কার এন্ট্রি।
ঢালিউডের রূপান্তর – ২০১৯–২০২১: বাংলাদেশের অস্কার যাত্রা অব্যাহত
২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক পুরস্কারে অংশগ্রহণ করেছে এবং প্রতি বছরই অস্কারে প্রতিনিধি পাঠিয়েছে।
“আলফা” এক নিঃশব্দ চিৎকার
২০১৯ সালে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ পরিচালিত “আলফা” অস্কারের Best International Feature Film বিভাগে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরিত হয়।
শিল্পী সমাজের নিঃসঙ্গতা, আধুনিক শহরের মানসিক শূন্যতা এবং মানুষের অস্তিত্ব সংকটের কাব্যিক উপস্থাপন এই ছবিকে করে তুলেছিল অনন্য।
যদিও এটি চূড়ান্ত মনোনয়ন পায়নি, তবুও আন্তর্জাতিক সমালোচকরা এটিকে “Bangladesh’s poetic visual language” বলে অভিহিত করেন।
“Made in Bangladesh” নারীর শ্রমজীবনের কণ্ঠস্বর
একই বছরে রুবাইয়াত হোসেনের “Made in Bangladesh” টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়।
গার্মেন্টস শ্রমিক নারীদের আত্মমর্যাদা, অধিকার ও প্রতিবাদের গল্প নিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্র বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়ায়।
এটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ দেখার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
২০২০ – “ইতি তোমারই ঢাকা” ও “The Grave”
২০২০ সালে বাংলাদেশের অস্কার প্রতিনিধি হয় “Sincerely Yours, Dhaka (ইতি তোমারই ঢাকা)”,
যা ১১ জন তরুণ নির্মাতার যৌথ প্রচেষ্টা।
চলচ্চিত্রটি মহানগর ঢাকা শহরের বৈপরীত্য, স্বপ্ন ও বঞ্চনার গল্প বলে।
এটি বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্র ভাষার প্রতীক হয়ে ওঠে।
একই বছর গাজী রাকায়েত পরিচালিত “The Grave (গর)” মুক্তি পায়।
এটি ইংরেজি ভাষায় নির্মিত প্রথম বাংলাদেশি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, যা যুক্তরাষ্ট্রেও প্রদর্শিত হয়।
ছবিটি মৃত্যুর দর্শন ও মানবিক পরিশুদ্ধির গল্প তুলে ধরে এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২০ এ ১১টি বিভাগে বিজয়ী হয়।
“রেহানা মরিয়ম নূর” নারীর প্রতিবাদের ভাষা
২০২১ সাল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যোগ করে।
আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ পরিচালিত “রেহানা মরিয়ম নূর” প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্র হিসেবে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের “Un Certain Regard” বিভাগে নির্বাচিত হয়।
নারীর মানসিক দৃঢ়তা ও সামাজিক দ্বন্দ্ব নিয়ে নির্মিত এই ছবিটি দেশীয় দর্শকের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।
পরবর্তীতে এটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অস্কারের Best International Feature Film বিভাগে প্রেরিত হয়।
একই সময়ে মুক্তি পাওয়া “Nonajoler Kabbo” এবং “Raat Jaga Phool” দেখিয়েছে যে বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতারা সমাজ, ধর্ম, এবং মানবতার প্রশ্নগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখেছেন।
এই সময়ের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত ছবি ছিল
- “Made in Bangladesh” (২০১৯) — রুবাইয়াত হোসেন; Toronto International Film Festival এ প্রদর্শিত।
- “The Grave (Gor)” (২০২০) — গাজী রাকায়েত পরিচালিত; জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ১১টি বিভাগে জয়ী।
- “Nonajoler Kabbo” (২০২১) — রেজাওয়ান শাহরিয়ার সুমিত; BFI London Film Festival এ প্রদর্শিত ও কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত।
- “Rehana Maryam Noor” (২০২১) — আন্তর্জাতিক সমালোচকদের চোখে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের পুনর্জন্ম।
ঢালিউডের রূপান্তর – ২০২২–২০২৫: নতুন প্রজন্মের আন্তর্জাতিক সাফল্য
বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতারা এখন বিশ্বের বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে নিয়মিতভাবে অংশ নিচ্ছেন ও পুরস্কার পাচ্ছেন।
- “Barir Naam Shahana” (২০২৫) লিসা গাজী পরিচালিত; ২০২৫ সালের জন্য বাংলাদেশের অস্কার প্রতিনিধি।
- MAMI Mumbai Film Festival এ Gender Sensitivity Award অর্জন করেছে।
- “Ali” (২০২৫) বিপ্লব হায়দার পরিচালিত; কান চলচ্চিত্র উৎসবে Special Mention পেয়েছে।
- “NeelChokro: Blue Circle” (২০২৫) Golden State Film Festival এ প্রদর্শিত বাংলাদেশের প্রথম এআই ভিত্তিক সাই-ফাই ছবি।
- “Sand City” (২০২৫) মাহেদ হাসান পরিচালিত; Karlovy Vary International Film Festival এ Proxima Grand Prix পুরস্কার জয় করে।
- “Borbaad” (২০২৫) ইন্দো বাংলা যৌথ প্রযোজনা; বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক আয়কারী সিনেমা।
- “Utshob” (২০২৫) প্রেক্ষাগৃহে রেকর্ড আয়ের পাশাপাশি সামাজিক বার্তা ও বিনোদনের মিশেলে সমাদৃত।
ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০২৫
২৩ তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (DIFF 2025) এ ৭৫টি দেশের ২২০টি সিনেমা প্রদর্শিত হয়, যার মধ্যে ৪৪টি ছিল বাংলাদেশের।
বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে “Priyo Maloti” FIPRESCI Best Full Length Feature Award লাভ করে, যা বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতাদের নতুন দিকনির্দেশনা দেয়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র: বিশ্বে নতুন পরিচয়
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এখন কেবল আঞ্চলিক নয়, বরং বৈশ্বিক শিল্পরূপে প্রতিষ্ঠিত।
কান, বার্লিন, টোকিও, টরন্টো, বিশ্বের বড় বড় চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে বাংলাদেশের নাম নিয়মিতভাবে উচ্চারিত হচ্ছে।
নতুন প্রজন্মের নির্মাতারা সমাজ, নারী অধিকার, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তি ও মানবতার গল্প বলছেন এমন দৃষ্টিভঙ্গিতে, যা বিশ্বজুড়ে প্রাসঙ্গিক। আরও সাহসী হচ্ছেন।
তারা সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম ও মানুষের অন্তর্লোক নিয়ে গল্প বলছেন এমন ভাষায়, যা বৈশ্বিক দর্শকের কাছেও প্রাসঙ্গিক।
ঢালিউডের রূপান্তর – বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক যাত্রা
সময়কাল | মূল প্রবণতা / ঘটনা | উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র | নির্মাতা / পরিচালক | আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও অর্জন |
---|---|---|---|---|
২০০২ | আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সূচনা | মাটির ময়না | তারেক মাসুদ | Cannes Film Festival (Directors’ Fortnight); প্রথম অস্কার এন্ট্রি (2003) |
২০০৬–২০০৮ | ধারাবাহিক অস্কার অংশগ্রহণের শুরু | শ্যামল ছায়া (2006), নিরন্তর (2007), স্বপ্নডানায় (2008) | হুমায়ূন আহমেদ, আবু সাইয়িদ, গোলাম রাব্বানী বিপ্লব | নিয়মিত অস্কার সাবমিশনের ধারা শুরু হয় |
২০১০–২০১৮ | নতুন ধারার উত্থান ও আন্তর্জাতিক উৎসব | গেরিলা (2011), টেলিভিশন (2012), উধাও (2013), মেহেরজান (2011), ডুব (2018) | নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অমিত আশরাফ, রুবাইয়াত হোসেন | Berlin, Busan, Toronto Film Festivals এ প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত |
২০১৯ | নারীর কণ্ঠ ও বাস্তবতার গল্প | আলফা, Made in Bangladesh | নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, রুবাইয়াত হোসেন | Toronto IFF; নারীর শ্রমজীবনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি |
২০২০ | তরুণ নির্মাতাদের যৌথ নির্মাণ ও পরীক্ষাধর্মী সিনেমা | Sincerely Yours, Dhaka, The Grave (গর) | ১১ তরুণ পরিচালক, গাজী রাকায়েত | যুক্তরাষ্ট্রে প্রদর্শিত; জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ১১ বিভাগে জয়ী |
২০২১ | আন্তর্জাতিক পুনর্জাগরণ ও নারী নেতৃত্বের সিনেমা | Rehana Maryam Noor, Nonajoler Kabbo | আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত | Cannes “Un Certain Regard”; BFI London, Kolkata IFF |
২০২২–২০২৩ | বাণিজ্যিক ও গল্পনির্ভর সফলতা | Hawa, Poran, Surongo, Priyotoma | মেজবাউর রহমান সুমন, রায়হান রাফি, রাফাত মজুমদার | Variety ও Indian Express এ প্রশংসিত; দেশীয় বক্স অফিসে রেকর্ড |
২০২৪ | আন্তর্জাতিক যৌথ প্রযোজনার বিস্তার | Overtrump, Baba, Someone’s Following Me | বাংলাদেশ–ফ্রান্স–কাতার / বাংলাদেশ–UK যৌথ উদ্যোগ | লন্ডন ও প্যারিসে প্রদর্শিত; কপোডাকশন শক্তিশালী হয় |
২০২৫ | নতুন প্রজন্ম ও গ্লোবাল সাফল্য | Barir Naam Shahana, Ali, NeelChokro: Blue Circle, Sand City, Borbaad, Utshob | লিসা গাজী, বিপ্লব হায়দার, মাহেদ হাসান | Cannes Special Mention, Karlovy Vary Grand Prix, Golden State Film Festival, MAMI Mumbai Award |
ঢালিউডের রূপান্তর – যৌথ প্রযোজনা ও আধুনিক চিন্তা
২০১০ সালের পর বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে দেখা যায় এক নতুন প্রবণতা, যৌথ প্রযোজনা (Co-production)।
প্রথমদিকে এই ধারা শুরু হয় ভারত বাংলাদেশের মধ্যে, মূলত বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার লক্ষ্য নিয়ে।
যদিও শুরুতে এটি নিয়ে বিতর্ক ছিল, তবুও বাস্তবে এই সহযোগিতা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে নতুন পরিসরে পৌঁছে দেয়।
শুরুর দিন: “ভালোবাসা আজকাল”, “Hero 420” থেকে “Shikari”
২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “ভালোবাসা আজকাল” ছিল ভারত বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার প্রথম দিকের সফল ছবি।
এরপর আসে “Hero 420” (২০১৬) ও “Shikari” (২০১৬) দুটোই বাণিজ্যিকভাবে হিট।
এই সময় বাংলাদেশের নায়ক শাকিব খান ভারতের নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করে ঢালিউডকে নতুন বাজারে পরিচিত করে তোলেন।
একইসঙ্গে ভারতীয় নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহকরা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন প্রযুক্তি, রঙ, ও ন্যারেটিভের ছোঁয়া আনেন।
তবে অনেকেই তখন প্রশ্ন তুলেছিলেন “আমাদের গল্প কি হারিয়ে যাচ্ছে?”
এ সময়ের বিতর্কটা আসলে ছিল শিল্প বনাম বাণিজ্য এর দ্বন্দ্ব।
অনেকে মনে করতেন যৌথ প্রযোজনায় দেশীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও চরিত্র হারানোর আশঙ্কা থাকে, আবার অন্যরা দেখেছেন এটি নতুন সুযোগ হিসেবে।
বাস্তব উদাহরণ: “Password” থেকে “Nabab”
২০১৮ সালে মুক্তি পায় “Password”, যা একদিকে প্রযুক্তিনির্ভর থ্রিলার, অন্যদিকে বাণিজ্যিক সফলতা।
একই বছর “Nabab” সিনেমা কলকাতায় বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।
এই চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়, যৌথ প্রযোজনার উদ্দেশ্য কেবল অর্থনৈতিক নয়;
এটি মূলত সংস্কৃতির বিনিময়, পারস্পরিক শিখন, এবং নতুন বাজারে প্রবেশের পথ তৈরি করছে।
“নবাব” এর পরিচালক জয়দীপ মুখার্জি পরে The Times of India কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন:
“Bangladesh’s energy in filmmaking is refreshing they have stories that Indian audiences connect with.”
নতুন যুগের সহযোগিতা: OTT ও আন্তর্জাতিক প্রযোজনা
২০২০ সালের পর থেকে যৌথ প্রযোজনার ধারা আরও প্রসারিত হয় এবার ভারতের বাইরেও।
Netflix ও Hoichoi Bangladesh এর মতো OTT প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শুরু হয় বাংলাদেশ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের যৌথ উদ্যোগ।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রকল্প:
- “Borbaad” (২০২৫) বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ইন্দো-বাংলা প্রযোজনা, যা ঈদে রেকর্ড পরিমাণ আয় করে।
The Times of India প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, “Borbaad has broken cross border box office records in South Asia.” - “Overtrump” (২০২3) বাংলাদেশ, ফ্রান্স ও কাতারের যৌথ প্রযোজনা; চলচ্চিত্রটি প্রযুক্তি ও মানবাধিকার প্রশ্নে নির্মিত।
- “Baba, Someone’s Following Me” (২০২4) — বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের যৌথ উদ্যোগ; লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত।
২০২০–২০২৫: OTT বিপ্লব, নতুন প্রজন্মের উত্থান ও মানবিক গল্প
ডিজিটাল দর্শক ও নতুন বাজারের জন্ম
২০২০ সালের শুরুতে বিশ্বজুড়ে যখন কোভিড মহামারি সিনেমা হল বন্ধ করে দেয়, তখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেরও এক যুগ শেষ হয় এবং একইসাথে শুরু হয় নতুন এক সময়ের।
এই সময়েই উঠে আসে এক শব্দ, যা এখন ঢালিউডের ভবিষ্যৎকে সংজ্ঞায়িত করছে OTT (Over The Top)।
Chorki, Binge, Bioscope, এবং Hoichoi Bangladesh এর মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো শুধু সিনেমা প্রদর্শনের মাধ্যম নয়, বরং বাংলাদেশের গল্প বলার নতুন জায়গা তৈরি করেছে।
একসময় যে দর্শকরা হলমুখী ছিলেন, তারা এখন মোবাইল বা টিভি স্ক্রিনে দেশীয় কনটেন্ট দেখছেন এবং এই পরিবর্তনই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বিপ্লব এনেছে।
নতুন ধারার গল্প ও মানবিক কাহিনি
২০২০ থেকে ২০২৫ সময়কালে বাংলাদেশি OTT প্ল্যাটফর্মগুলো একের পর এক সফল প্রজেক্ট দিয়েছে।
এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত কনটেন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে :
- “তকদীর” (২০২০, Chorki) — সৃজিত মণ্ডল পরিচালিত থ্রিলার সিরিজ, যেখানে চঞ্চল চৌধুরীর অনবদ্য অভিনয় দর্শকদের নতুন এক ক্রাইম নোয়ার অভিজ্ঞতা দেয়।
- “কারাগার” (২০২২, Chorki) — সৈয়দ আহমেদ শাওকী পরিচালিত এই ওয়েব সিরিজ শুধু দেশে নয়, বিদেশেও আলোচিত হয়।
The Indian Express লিখেছিল, “Karagar is proof that Bangladeshi storytelling has matured beyond expectations.”
- “মরীচিকা” (২০২১, Chorki) — সামাজিক বাস্তবতা ও মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন নিয়ে নির্মিত; এর সংলাপ “আমরা সবাই একটা মরীচিকা খুঁজছি” এখনো ভাইরাল।
- “হাওয়া” (২০২২) — মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত চলচ্চিত্রটি থিয়েটার ও OTT দু’ক্ষেত্রেই সাড়া ফেলে।
Variety–র এক প্রতিবেদনে এটিকে বলা হয় “Bangladesh’s most visually poetic sea story.”
- “পরান” (২০২২) — রায়হান রাফি পরিচালিত প্রেম ও অপরাধের মিশ্র গল্পটি তরুণ প্রজন্মকে আবার প্রেক্ষাগৃহে ফিরিয়ে আনে।
- “সুরঙ্গ” (২০২৩) — সিয়াম আহমেদ অভিনীত সাসপেন্স থ্রিলার, যা OTT ও সিনেমা হল , দুই জায়গাতেই সমান জনপ্রিয় হয়।
- “প্রিয়তমা” (২০২৩) — আরিফিন শুভ ও ইদ্রিস হায়দার প্রযোজিত রোমান্টিক অ্যাকশন, যা দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশে মুক্তি পায় এবং সর্বাধিক আয়কারী চলচ্চিত্রে পরিণত হয়।
বাস্তব গল্প: পরিচালক সৈয়দ আহমেদ শাওকী ও অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী
“কারাগার” এর স্রষ্টা সৈয়দ আহমেদ শাওকী এক সাক্ষাৎকারে (Dhaka Tribune, ২০২3) বলেন,
“OTT আমাদের এমন গল্প বলতে দিয়েছে যা আগে সেন্সর বোর্ডে আটকে যেত।”
অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী যোগ করেন
“দর্শক এখন শুধু তারকাকে দেখে না, গল্প দেখে। এটাই আমাদের জয়ের দিক।”
এই বাস্তব কথাগুলো বোঝায়, বাংলাদেশের সিনেমা এখন গল্পনির্ভর হয়ে উঠেছে, তারকা নির্ভর নয়।
OTT অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক দর্শক
২০২৪ সালের TBS News প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের OTT বাজারের আকার এখন প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার বেশি, এবং এর ৩৫% ব্যবহারকারী প্রবাসী বাংলাদেশি দর্শক।
এটি প্রমাণ করে যে, চলচ্চিত্র এখন দেশের সীমা পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের প্রযোজনা সংস্থা Chorki Originals জানিয়েছে, তাদের ২০২৪ সালের মোট দর্শকের ৪২% এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে।
এই পরিবর্তন শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি গ্লোবাল সাংস্কৃতিক পুনর্জন্ম।
অর্থনীতি ও বাজারে প্রভাব
The Business Standard একটি বিশ্লেষণে বলেছে, “প্রিয়তমা ও সুরঙ্গ যেন ঢাকা চলচ্চিত্রের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে।” তারা দেখিয়েছে, সাময়িক মন্দার মধ্যেও নতুন ধরনের কনটেন্ট দর্শক আনতে পারে। The Business Standard
এই নতুন ধারা শুধুই সীমিত শাখার গল্প নয়; বাজার এবং আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলোতে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।
ঢালিউডের রূপান্তর – সাম্প্রতিক সাফল্য: “বরবাদ” ও “আলী”
২০২৫ সালে মুক্তি পাওয়া “বরবাদ” বক্স অফিসে সর্বকালের সর্বোচ্চ আয় করে ঢালিউডে নতুন ইতিহাস গড়েছে।
একই বছর মুক্তি পায় মানবিক গল্পভিত্তিক সিনেমা “আলী”, যা বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতার এক মর্মস্পর্শী উপস্থাপন।
“আলী” (২০২৫) চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন বিপ্লব হায়দার, এবং প্রযোজনা করেছেন তাজুল ইসলাম।
ছবির মূল চরিত্র “আলী” একজন কথা বলতে অক্ষম তরুণ, যার জীবনের সংগ্রাম, প্রেম, পরিবার ও সমাজে নিজের জায়গা খোঁজার গল্পই সিনেমাটির কেন্দ্রবিন্দু।
অভিনেতা ইরফান সাজ্জাদ পুরো চলচ্চিত্রে কোনো সংলাপ উচ্চারণ না করেও মুখাভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের হৃদয় জয় করেন।
ছবিটি মুক্তির পর সমালোচকরা বলেন, “আলী হলো মানবিক আবেগ ও নীরবতার ভাষায় বলা এক অসাধারণ চলচ্চিত্র।”
এই চলচ্চিত্র প্রমাণ করে, ঢালিউড শুধু বাণিজ্যিক বিনোদনের নয় , এটি শিল্প ও মানবিকতারও এক শক্তিশালী মাধ্যম।
ভবিষ্যতের ঢালিউড: আশার আলো ও চ্যালেঞ্জ
সম্ভাবনার দিগন্ত
- আন্তর্জাতিক OTT প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ: Netflix ও Amazon Prime–এ বাংলাদেশি কনটেন্ট প্রদর্শনের উদ্যোগ শুরু হয়েছে।
- নারী ও তরুণ নির্মাতাদের উত্থান: রুবাইয়াত হোসেন, সঞ্চারী মিত্রসহ নতুন নির্মাতারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছেন।
- VFX, CGI ও 3D প্রযুক্তি: নতুন প্রজন্মের সিনেমা প্রযুক্তিগত মানে দক্ষিণ এশিয়ার মান স্পর্শ করছে।
- থিয়েটার সংস্কার: ঢাকা ও চট্টগ্রামে আধুনিক মাল্টিপ্লেক্স বাড়ছে, দর্শক ধীরে ধীরে হলে ফিরে আসছেন।
চলমান চ্যালেঞ্জ
- পাইরেসি এখনও বড় হুমকি।
- অনুমোদন (NOC) ও সেন্সর বোর্ডের বিলম্বে অনেক প্রজেক্ট আটকে যায়।
- থিয়েটারের সংখ্যা কম, ফলে একাধিক সিনেমা একই দিনে মুক্তি দিয়ে বাজার ভরে ফেলা হয়।
- অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণ এখনও কঠিন।
তবুও, নতুন প্রজন্মের উদ্যম, আন্তর্জাতিক সংযোগ, এবং দর্শকের পরিবর্তিত রুচি ঢালিউডকে একটি নতুন যুগে নিয়ে যাচ্ছে।
শেষ কথা: ঢালিউড এক চলমান মানবিক যাত্রা
ঢালিউডের ইতিহাস কেবল সিনেমার নয়, এটি একটি জাতির পরিচয়ের বিবর্তন।
১৯৫৬ সালে “মুখ ও মুখোশ” দিয়ে শুরু হওয়া এই যাত্রা আজ ডিজিটাল যুগে “আলী”, “হাওয়া” বা “বরবাদ”এর মতো চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নতুন রূপ নিচ্ছে।
এই দীর্ঘ যাত্রায় ঢালিউড কখনো থেমে যায়নি। কখনো গৌরব, কখনো সংকট, কখনো পুনর্জাগরণ কিন্তু সব সময়ই এটি মানুষের গল্প বলেছে।
আজকের চলচ্চিত্র নির্মাতারা বুঝেছেন, মানুষের হৃদয়ের গল্পই ঢালিউডের আসল শক্তি।
আর সেই শক্তি নিয়েই বাংলাদেশি সিনেমা এখন বৈশ্বিক মঞ্চে নিজের পরিচয় তৈরি করছে , নিজের ভাষায়, নিজের গল্পে, নিজের আবেগে।
রেফারেন্স
- Wikipedia: Ali (2025 feature film)
- Wikipedia: Cinema of Bangladesh
- The Financial Express (2024): Bangladesh’s Film Industry Will There Be Light?
- Dhaka Tribune (2024): New Era of OTT Films in Bangladesh
- Inside Bangladesh: Dhallywood in Decline
- TBS News (2025): The Explosive Golden Age of Dhallywood Action
- Views Bangladesh (2025): Will the Winds of Change Reshape Bangladeshi Cinema?
- ‘মাটির ময়না’—Cannes Directors’ Fortnight + FIPRESCI: The Business Standard+1
- ‘রেহানা মরিয়ম নূর’—Un Certain Regard + Oscar submission: Wikipedia+1
- ‘The Grave (গর)’—জাতীয় পুরস্কার ২০২০-এ ১১ পুরস্কার: Wikipedia
- ‘নোনাজলের কাব্য’—BFI London Film Festival/ইউরোপীয় সার্কিট: Wikipedia+1
- ‘হাওয়া’—রিলিজ/ব্যবসা/অস্কার সাবমিশন/১০০-দিন শো: Wikipedia+1
- ‘কারাগার’—ToI ৪/৫ রিভিউ/বাংলাদেশ–ভারতে গ্রহণযোগ্যতা: The Times of India+1
- Chorki—৪ বছর, ১B+ watch-hours/৩০M users: Prothomalo
- ‘Borbaad’—Eid রেকর্ড, ১২০ থিয়েটার/৫৬০ শো/মিডনাইট শো: The Times of India
- ২০২৫ অস্কার সাবমিশন—‘Barir Naam Shahana’: Dhaka Tribune
- Cannes ২০২৫—‘ALI’ (Short Film) Special Distinction (অফিশিয়াল): Festival de Cannes
- Karlovy Vary ২০২৫—‘Sand City’ Proxima Grand Prix (Screen Daily): Screen Daily
- DIFF ২০২৫—২২০ ফিল্ম, ৭৫ দেশ; ‘Priyo Maloti’ FIPRESCI: The Financial Express+1
FAQ for ঢালিউডের রূপান্তর: ১৯৬০ সাল থেকে ২০২৫
বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র হলো “মুখ ও মুখোশ” (১৯৫৬)।
এটি পরিচালনা করেছিলেন আব্দুল জব্বার খান, যিনি বাংলা চলচ্চিত্রের জনক হিসেবেও পরিচিত।
স্বাধীনতার বছর ১৯৭১ সালে মোট আটটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য “স্বরলিপি”, “নাচের পুতুল”, “স্মৃতিটুকু থাক” এবং “সুখ দুঃখ” যা যুদ্ধের ছায়াতেও মানবিক সম্পর্কের গল্প বলে।
বিগত কয়েক দশকের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে সফল চলচ্চিত্র হিসেবে “বেদের মেয়ে জোসনা” (১৯৮৯) এবং সাম্প্রতিককালে “বরবাদ” (২০২৫) শীর্ষে রয়েছে।
উভয় ছবিই মুক্তির পর দর্শকপ্রিয়তা ও আয় দু’দিক থেকেই রেকর্ড গড়ে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে প্রথমবারের মতো বিশ্বমঞ্চে পরিচয় করিয়ে দেয় “মাটির ময়না” (২০০২, তারেক মাসুদ)।
এই ছবিটি কান চলচ্চিত্র উৎসবের Directors’ Fortnight বিভাগে প্রদর্শিত হয় এবং FIPRESCI পুরস্কার লাভ করে।
বাংলাদেশ ২০০৩ সালে “মাটির ময়না” চলচ্চিত্র দিয়ে প্রথমবার অস্কারে অংশগ্রহণ করে।
এরপর ২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছরই Best International Feature Film বিভাগে একটি করে সিনেমা প্রেরণ করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর আলোচিত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবির মধ্যে রয়েছে
“রেহানা মরিয়ম নূর” (২০২১), “Barir Naam Shahana” (২০২৫),
“Ali” (২০২৫), “Sand City” (২০২৫), এবং “Hawa” (২০২২)।
এই ছবিগুলো কান, কার্লোভি ভ্যারী, টরন্টো ও মুম্বাই ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়েছে।
কোভিড-১৯ (২০২০) পরবর্তী সময়ে OTT প্ল্যাটফর্ম যেমন Chorki, Binge, ও Bioscope জনপ্রিয়তা পায়।
এগুলোতেই “কারাগার”, “তকদীর”, “মরীচিকা”, “সুরঙ্গ” ও “প্রিয়তমা”র মতো হিট কনটেন্ট তৈরি হয়,
যা বাংলাদেশের ডিজিটাল সিনেমা শিল্পকে নতুন যুগে প্রবেশ করায়।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনা শুরু হয় ২০১০-এর দশকে।
“ভালোবাসা আজকাল” (২০১৩), “Hero 420” (২০১৬) ও “Shikari” (২০১৬)
এই ধারার প্রথম বাণিজ্যিক সাফল্য; সাম্প্রতিক “Borbaad” (২০২৫) এই সহযোগিতার সর্বাধিক সফল উদাহরণ।
ভবিষ্যৎ ঢালিউড প্রযুক্তিনির্ভর ও বৈশ্বিক হবে।
OTT-এর পাশাপাশি Netflix, Amazon Prime-এ বাংলাদেশি সিনেমা প্রদর্শনের উদ্যোগ চলছে।
নতুন প্রজন্মের নির্মাতা, নারী পরিচালক, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্বে এক নতুন অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে।