Chitralee will take you closer to the world of entertainment.
Chitralee will take you closer to the world of entertainment.
শুক্রবার, অক্টোবর ১৮, ২০২৪

আইয়ুব বাচ্চু: তবুও একাকী ভিন্ন গ্রহে

দেশের গিটার উইজার্ড আইয়ুব বাচ্চু | ছবি: গুগল

গিটার ছিল তার অস্ত্র। সুর ছিল তার ম্যাগাজিন। আর শব্দ ছিল বুলেট। আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন এমনই যোদ্ধা। তিনি যোদ্ধা ছিলেন রক আকাশে, তিনি সৈনিক ছিলেন ব্যান্ড মিউজিকের, তিনি ছিলেন অনেকের শিক্ষক, কারো গুরু, কারো কাছে দেবতাতূল্য। তিনিই সেই আইয়ুব বাচ্চু, তারা ভরা রাতে যাকে ভক্তরা ফেরাতে পারেনি। সুর ছোঁয়াতে ঘুমন্ত শহরকে না জাগিয়েই চলে গেছেন আইয়ুব বাচ্চু।

২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর অনেকের ঘুম ভাঙতেই যে খবরটা আকাশসমান কষ্ট দিয়েছিল- তা ছিল আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর সংবাদ। মাত্র দুইদিন আগেই রংপুরে কনসার্ট করে আসা আইয়ুব বাচ্চু এভাবে ফেরারি হবেন কে ভেবেছিল? 

এখনও তো চলার অনেক দিন বাকী, এখনো! মৃত্যুর ছয় বছর পরেও এমনটাই ভাবেন আইয়ুব বাচ্চুর ভক্তরা। পশ্চিমবঙ্গের কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও ক্রিয়েটিভ হেড ঋদ্ধি বড়ুয়া একবার বলেছিলেন, সে সময়টা ছিল ক্যাসেট আর আর রেকর্ডের। আমরা অপেক্ষায় থাকতাম কখন বাংলাদেশ থেকে নতুন রিলিজড ক্যাসেট আসবে যেখানে আইয়ুব বাচ্চুর বাজানো শুনতে পাবো। আমরা পজ করে, রিপ্লে করে তার কাছ থেকে গিটার বাজানো শিখেছি। তিনি তো আমাদের গিটার গুরু।’ কথা প্রসঙ্গে ঋদ্ধি আরো বলেছিলেন, তিনি যে কত বড় শিল্পী- তা হয়তো আরো অনেকদিন পর সকলে বুঝবে।

পশ্চিমবঙ্গের এমন হাজারো ব্যান্ড প্রেমী মিউজিশিয়ান আছে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আইয়ুব বাচ্চুর কাছ থেকেই গিটার বাজানোর দীক্ষা নিয়েছেন। আর বাংলাদেশের কথা তো বলতেই হয়। ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’ বা ‘ঘুমন্ত শহরে’ গানের কর্ড বাজিয়ে কত তরুণের স্বপ্নের শুরু- তার হিসাব নেই। কষ্ট কাকে বলে- গেয়ে কত সাধনার শুরু তারও কোনও তালিকা কেউ করতে পারেনি। করতে পারবেও না হয়তো। কারণ শিল্পচর্চা আর শেখার কোনও সীমানা কেউ কখনো করতে পারেনি।

আইয়ুব বাচ্চু নিজেও তার ধ্যান- সাধনাকে কখনো সীমানাতে আবদ্ধ রাখেননি। মগবাজারে তার স্টুডিও এবি কিচেনে রোজ বসতো আড্ডা। সাংবাদিক- শিল্পী- লেখক সকলের আড্ডা জমে যেত সেখানে। হতো নতুন কিছু করার পরিকল্পনা রোজ। সে সময়ের অনেক তরুণ সাংবাদিককে তিনি ঠাঁই দিয়েছিলেন ভালোবেসে। কোনও কিছু পাওয়ার আশায় নয়। এবি তথা আইয়ুব বাচ্চু এমনই মহীরুহ, যিনি দিতেই জানেন, কোনও কারণ ছাড়া।

আইয়ুব বাচ্চুর সাথে অনেক ‘প্রথমে’র সম্পর্ক আছে। টেলিকম কোম্পনি গ্রামীনফোনের একসময়ের গ্রাহকপ্রিয় ব্র্যান্ড ডিজুসের রিয়েলিটি শো ডি রকস্টার মূলত বলা যায় আইয়ুব বাচ্চুর উপরেই ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। ডিজুসের রিয়েলিটি শো ডি রকস্টার প্রোগ্রামটিই প্রথম রকস্টার তৈরির আয়োজন ছিল বলা যেতে পারে। এর আগেও ‘স্টারসার্চ  বেনসন অ্যান্ড হেজে’ প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। এরপর আরো একাধিক রিয়েলিটি শোয়ের বিচারক হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন তিনি।

আইয়ুব বাচ্চুই ছিলেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের প্রথম আবেদনকারী- তৎকালীন কপিরাইট অফিসের রেজিস্টার জাফর রাজা চৌধুরী। জানা যায়, আইয়ুব বাচ্চুর কপিরাইট নিবন্ধনকৃত ২৭২টি গানের মেধাস্বত্ত্ব সংরক্ষণ ও ডিজিটাল আরকাইভিং কর্মসূচি নেয় বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস। যার উদ্বোধন হয় ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর। সেই কর্মসূচির অধীনে এমসিএন কোম্পানি জেড. এম. স্টুডিও’র সহযোগিতায় বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া যেমন- ইউটিউব, আই-টিউন, ফেসবুক, অ্যামাজনসহ ডিজিটাল মাধ্যমে চ্যানেল খুলে মনিটাইজিং ও ডিজিটাল সিঙ্কিয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর ফলে এক বছরে সামাজিক মাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আইয়ুব বাচ্চুর রেজিস্ট্রার্ড এ্যাকাউন্ট ‘এবি কিচেন’-এ রয়্যালিটি হিসেবে ৫০১৪.০৮ মার্কিন ডলার জমা হয়।

আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। আর তার সেসব স্বপ্ন ছিল ব্যান্ড সঙ্গীতকে নিয়ে। তাই চ্যানেল আই আয়োজিত তারকা কথনে তিনি বলেন, ‘আমি একটি দিন চাই ব্যান্ড মিউজিকের জন্য।’ তারকা কথন অনুষ্ঠানে আইয়ুব বাচ্চুর সেই লাইভ শো দেখছিলেন চ্যানেল আইয়ের অন্যতম প্রধান ফরিদুর রেজা সাগর। তিনি সাথে সাথে প্রযোজক অনন্যা রুমার মাধ্যমে ডিসেম্বরের ১ তারিখকে ব্যান্ড সঙ্গীত দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন। ২০১৪ সালে চ্যানেল আইয়ের ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনে এই দারুণ ঘটনাটি ঘটে যায়। সে হিসাব অনুযায়ী দশ বছরে পড়ছে এই ব্যান্ড সঙ্গীত দিবসটি। তিনি সারা জীবন লড়ে গেছেন, কথা বলে গেছেন ব্যান্ড সঙ্গীতের জন্য। তাই তার ছেলেকে নিয়ে মঞ্চে পারফর্ম করার সময়ও তিনি বলেছেন ব্যান্ড শিল্পীদের ন্যায্য পারিশ্রমিকের কথা। তাই তিনি চলে গেলেও তার বলে যাওয়া শব্দ আজও অনেকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়।

দুই বাংলার শ্রোতপ্রিয় মুখ অঞ্জন দত্তও বলেন আইয়ুব বাচ্চুর কথা। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে একটি ফিল্ম ফেস্টিভালে এসে এক আড্ডায় তিনি বলেন, ‘আমাদের সময়, আমাদের আড্ডায় সীমানা আর গাম্বীর্য কোনটাই ছিলনা। আড্ডা দিতে দিতে বাচ্চু কী দারুণ পিস বাজাতো!’ এমনভাবেই আড্ডায় হোক বা আয়োজনে সুর – আর গিটার নিয়েই বাচ্চু ছিলেন সরব। তবে অনেকের মতই তিনি নিজের প্রতি ছিলেন উদাসীন। এজন্যই হয়তো তার হঠাৎ চলে যাওয়া। তবে চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়। যে চট্টগ্রামের মাটিতে মাত্র ১১ বছর বয়সে তার গিটার বাজানো শুরু, সেই চট্টগ্রামের বুকে মাথা উঁচু করে আছে তার গানের আদলে তৈরি রূপালি গিটার। শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান এখন এই রূপালি গিটার।

আইয়ুব বাচ্চু ফাউন্ডেশন নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে সুবিধাবঞ্ছিতদের জন্য। ২০২৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় বন্যার্তদের সহায়তা করেছে এই ফাউন্ডেশন। ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর ২০ বছর আগে ১৯৯৮ সালের বন্যায় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন। সে সময় মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া মিলেছিল। সেই অনুপ্রেরণা আজও বিদ্যমান। এখনও যেকোনও কনসার্টে আইয়ুব বাচ্চুকে স্মরন করে শিল্পীরা শ্রদ্ধা জানায়, কখনো গান গেয়ে – কখনো গিটার বাজিয়ে। আর্টসেল থেকে অনি হাসান, যেই মঞ্চে উঠেছেন, ভালোবেসে কেঁদেছেন এবির জন্য। এবির মৃত্যুর পরে যেভাবে কেঁদেছিলেন জেমস। 

লোকে বলে অভিমান, অথচ অনেকে জানেন আইয়ুব বাচ্চু ও জেমস- এ দুই জনে ফিলিংস দিয়ে সেই আশির দশকে যাত্রা শুরু করেন। যে ফিলিংস এখন নগর বাউল। এক ঘর ছাড়া কিশোর জেমস ১৯৭৭ সালে আরেক গিটার পাগল আইয়ুব বাচ্চুকে বাজাতে দেখে মুগ্ধ হয়ে ব্যান্ডে আমন্ত্রণ জানান। সেই মুগ্ধতার ধরণ হয়তো বদলেছে, ভালোবাসা বদলায়নি। এরপর সোলসে ১৯৮০ থেকে টানা দশ বছর বাজান বাচ্চু। এরপর নিজে কিছু করার আশা থেকে ১৯৯০ সালে গড়ে তোলেন ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’, যা পরে ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’ বা ‘এলআরবি’ নামে আজও জীবন্ত ইতিহাস।

এবি আসলে কোন গল্প বা কবিতা নয়। এবি হলেন উপন্যাস। তাও আবার অজানা খণ্ডের। যে উপন্যাসের পাঠক শ্রোতা- ভক্ত সহকর্মী- সকলেই। তাই এখনো তাকে মনে পড়লেই অজান্তেও কেউ গেয়ে উঠেন,

কখনো ভাবিনি আমি

ব্যথা দিয়ে তুমি চলে যাবে

কি জানি কি ভুল ছিল আমার

আমাকে কেন গেলে কাঁদিয়ে’

Share this article
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Read next

সুন্দরী প্রতিযোগিতার যাত্রায় অভিনেত্রীরা

প্রতি বছরই হচ্ছে নিত্য নতুন সুন্দরী প্রতিযোগিতা। নানা নামে, নানা পরিচয়ে। সেই প্রতিযোগিতা থেকে বিদেশে বাংলাদেশকে…

স্মরণে সালমান শাহ’র টেলিভিশনের অধ্যায়

আজ (১৯ সেপ্টেম্বর) বাংলা সিনেমার অমর নায়ক সালমান শাহ’র ৫৩তম জন্মবার্ষিকী। বেঁচে থাকলে আজ তিনি পা রাখতেন…

‘লাপাত্তা’ স্টারজ

নতুন বাংলাদেশে সকলেই সংস্কার চায়। যৌক্তিক দাবী নিয়ে সকলেই সামনে। বিশেষ করে তারকারা। কারণ সহিংসতার শুরু হতেই…
0
Share