নতুন বাংলাদেশে সকলেই সংস্কার চায়। যৌক্তিক দাবী নিয়ে সকলেই সামনে। বিশেষ করে তারকারা। কারণ সহিংসতার শুরু হতেই বিপ্লবে একাত্মতা প্রকাশ করেন অনেকেই। তবে আজকের চিত্রালীর ফিচার একটু অন্য বিষয় নিয়ে- যারা একটু অন্যরকমের ভূমিকাতে ছিলেন, বা কোনও কারণে নিজের অবস্থান তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিশেষ করে তাদের নিয়ে, ৫ আগস্টের পর থেকে যারা আছেন নিখোঁজ, বা আমির খানের সিনেমার ভাষায়, ‘লাপাত্তা’।
‘লাপাত্তা’ শব্দটির সাথে প্রথমেই চলে আসে সাবেক সংসদ সদস্য ফেরদৌসের নাম।
ঢাকা ১০ আসনে সাংসদ নির্বাচিত হলেও শিল্পী সমাজে ফেরদৌসের অবস্থান অভিনেতা হিসেবেই ছিল। ছাত্র- জনতার বিপ্লবে খানিকটা বিপরীতে স্থান নিয়ে বিটিভি পরিদর্শন করতে তিনি তারকাদের একটি দল নিয়ে হাজির হন এবং সেখানে বলেন, ‘দেশ শেখ হাসিনা ঠিক করে ফেলবেন কিন্তু যারা চলে গেছেন তাদের আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।’
সেখানে তার সঙ্গী হবার জন্য অনেককেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে ফোন করেন।
বর্তমানে ফেরদৌস লাপাত্তা একেবারে। জোর গুঞ্জন ওঠে, তিনি সীমান্ত পার হয়ে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের বাড়িতে অবস্থান করছেন। ঋতুপর্ণা অবশ্য সেই গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে জানান, ফেরদৌস তার বাড়িতে নেই। তিনি দেশেই কোথাও আত্মগোপনে আছেন, বা কলকাতাতে হলে- তার জানা নেই।
ফেরদৌসের সাথে সেদিন বিটিভি প্রাঙ্গণে গিয়েছিলেন শমী কায়সার, নিপুণ আক্তার, রোকেয়া প্রাচী, শামীমা তুষ্টি, সুইটি, রিয়াজসহ অনেকেই।
মূলত ১ আগস্টে যখন একদল তারকা ছাত্র জনতার উপর বিনা বিচারে বুলেটের নিন্দা জানাচ্ছিলেন, এবং অবস্থান পরিষ্কার করছিলেন, সেদিনই বিটিভি পরিদর্শনে গিয়ে আরো বেশি জনতার ক্ষোভের মুখে পড়ের যারা, তার মাঝে অন্যতম ছিলেন রিয়াজ। তিনি তার আগে একটি বক্তব্যে বলেন, যতদিন ফেরদৌস থাকবেন আসনে, ততদিন পাশে থাকবেন তিনি। দর্শকরা তাই খানিকটা কৌতুকের সুরেই বলছেন, একারণে রিয়াজও লাপাত্তা ফেরদৌসের সাথে সাথে। জানা গেছে, সাবেক সামরিক সদস্য বলে হয়তো তিনি ঢাকাতেই কোনও নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছেন।
একই ভাবে রোষানলে পড়েছেন শমী কায়সার। জহির রায়হানের ভাই শহিদুল্লাহ কায়সারের কন্যা শমী কায়সারকে স্রোতের বিপরীতে দেখে দর্শকরা আহত হয়েছেন মানসিক ভাবে- যা সামাজিক মাধ্যমে অনেকটাই অভিমানের সুরে তারা জানিয়েছে।
সেই থেকে শমীও নেই ক্যামেরার সামনে। শিল্পী জীবনের পাশাপাশি ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও বিপাকে আছেন তিনি। সদ্যই ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাবের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন এই অভিনেত্রী। পদত্যাগপত্রে শমী কায়সার উল্লেখ করেছেন, ‘বর্তমানে নিজের শারীরিক অবস্থা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আমি ই–ক্যাব সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করছি এবং তাৎক্ষণিকভাবে পদত্যাগপত্রটি কার্যকর করার অনুরোধ করছি।’ পদত্যাগের ব্যাপারে জানতে শমী কায়সারকে ফোনেও পাওয়া যায়নি।
আরো লাপাত্তা নিপুণ আক্তার। শেখ সেলিমের প্রচ্ছন্ন ক্ষমতায় চলচ্চিত্র অঙ্গনে দাপট ছিল বলে বর্তমানে অভিযোগ করছে অনেকেই। শিল্পী সমিতির নির্বাচনে না জিতেও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তিনি সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে ২ বছর ছিলেন।
নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় শিল্পী সমিতির প্যাড ব্যবহার করে গত জুলাই মাসে বিবৃতি দেন নিপুণ। এরপর তিনি বর্তমান কমিটির নির্বাচিত সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন, এটা তিনি সাংগঠনিক নিয়মে করতে পারেন না। বিবৃতি নিয়ে শিল্পীরা নিপুণের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তাকে পাওয়া যায়নি। একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি দেশেই আছেন।
চলচ্চিত্র নায়িকা অঞ্জনা ও অভিনেত্রী তারিন জাহানও লাপাত্তা। আন্দোলনের সময়জুড়ে অভিনেত্রী অঞ্জনা ছিলেন শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে। অপরদিকে নেটিজেনদের দৃষ্টিতে তারিন চিহ্নিত হয়েছেন সুবিধাবাদী হিসেবে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চিত্রনায়িকা অঞ্জনা রীতিমত প্রকাশ্যে শিক্ষার্থীদের গালামন্দও করেন। তার সেইসব পোস্ট রীতিমত ভাইরাল। ৩ আগস্ট এফডিসিতে টেলিভিশনে ভাঙচুর, মেট্রো রেল স্টেশন, এলিভেটর এক্সপ্রেস টোল প্লাজাসহ দেশের বিভিন্ন জনসেবামূলক স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসাত্মক হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধনে অংশ নেন তিনি। তবে ৫ আগস্টের পর তাকে আর দেখা যায়নি।
এদিকে অভিনেত্রী তারিন বিএনপি’র আমলে ছিলেন জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেত্রী, আর আওয়ামীলীগ আসার পর হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের নেত্রী। বিগত সরকারের আমলে একাধিক মন্ত্রী- সাংসদের সাথে ভালো সম্পর্কের জের ধরে সুযোগ সুবিধা নেবার অভিযোগ আছে তার বিপরীতে। পাশাপাশি আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ আনছেন অনেকেই। বিগত সরকারের প্রধানের চোখে পড়তে বিভিন্ন কর্মকান্ড ও সামাজিক মাধ্যমে তার প্রয়াসের কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরেও ছিলেন তারিন জাহান। তবে ৩৬ জুলাই তথা ৫ আগস্টের পর থেকে তার খবর জানাতে পারছেন না তার কোন সহকর্মী, বন্ধু বা স্বজন।
খোঁজ নেই গায়িকা মমতাজের। ২০০৮ সালে সংরক্ষিত মহিলা আসনে এবং ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। রেমিট্যান্স নিয়ে তার একটি বিতর্কিত বক্তব্য ভাইরাল হয়ে যায়। যাতে আরো বেশি জনরোষের মুখে পড়েন মমতাজ। তিনি কোথায় আছেন কেউ জানে না। তবে নির্ভরযোগ্যসুত্র বলছে, ঘটনার আঁচে আগেভাগেই দেশ ত্যাগ করেছেন লোকাল বাসখ্যাত গায়িকা মমতাজ।
মমতাজের মতই লাপাত্তা আরও দুই সাবেক সংসদ সদস্য। যেমন পাঁচবারের এমপি আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক নারী সংরক্ষিত আসনের এমপি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী তারানা হালিমের কোনো খোঁজ নেই কোথায় আছেন তারা।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন মিটিং মিছিলে সক্রিয় ভূমিকা রাখা অভিনয়শিল্পী সুজাতা, অরুণা বিশ্বাস, তানভীন সুইটি, আজিজুল হাকিম, জ্যোতিকা জ্যোতি, সাজু খাদেম, সোহানা সাবা, চন্দন রেজা, শুভ্র দেব, পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার, এসএ হক অলিক, প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরুসহ অনেকেই লাপাত্তাই বলা চলে। অনেকটা মান্না দে’র গানের মত, নেই তারা আজ কোনও খবরে।
লেখা: সৈয়দা ফারজানা জামান রুম্পা