উত্তাল দেশ। উত্তাল ছাত্ররা। জুলাই মাসের মাঝ থেকে রাতারাতি বদলে যেতে থাকলো কোটা সংস্কারের আন্দোলন। বরং তা হয়ে গেল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলন যা আপাত দৃষ্টিতে শুধু ছাত্রদেরই ছিল, শিক্ষক – অভিভাবক হয়ে তা ছুয়ে যায় একটা সময় সারা দেশের সাধারণ জনতার মাঝে। বিশেষ করে ১৬ – ১৭ -১৮ জুলাই পাবলিক- প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল কলেজ ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদে সশস্ত্র হামলা করার কারণে রাস্তায় নেমে আসেন সবাই। সেই কাতারে ছিলেন বিনোদন জগতের অনেক পরিচিত মুখ।
চিত্রালীর আজকের বিশেষ ফিচার তাদেরকে নিয়েই। তবে এই পর্ব শুধু নারী কণ্ঠদের নিয়ে। হ্যাঁ, বলছি সেই নারীদের কথা যারা এই আন্দোলনে সামনে থেকে নির্ভয়ে – নিসংকোচে সত্যকে উপস্থাপন করেছেন। যারা শুরু থেকেই ছিলেন ছাত্র জনতার সাথে।
প্রথমেই চলে আসে সাফা কবিরের কথা। সাফা কবিরকে সকলে পর্দার বাবলি- আদুরে হিসেবে জানলেও ১৯ জুলাই তাকে দেখা যায় ভিন্ন রূপে। ১৬ তারিখে রংপুরে আবু সাইদের বুক পেতে বুলেট নেওয়া, ১৮ জুলাই ছাত্র জনতার উপর আক্রমণ,মুগ্ধ নামের ছেলেটির পানি দিতে দিতে কপালে গুলি লাগাসহ হোস্টেলে ঢুকে ছাত্রদের উপর নির্যাতনসহ বিনা বিচারে সশস্ত্র হামলার প্রতিবাদে সংসদ ভবনের সামনে হওয়া একটি মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বলেন, ‘ছাত্ররা কেন মারা যাবে…?’
সাফা কবিরের এই বলিষ্ঠ উচ্চারণ অনেক তারকাকেই সত্যের পথে শরিক হতে সাহস জুগিয়েছিল। এরপর তাকে আবারও ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে থাকা শিক্ষার্থীদের মাঝে খাবার বিতরণ করতে দেখা যায়।
এরপরেই রক্তক্ষয়ী জুলাই যেন কেউ ভুলে না যায়, একারণে ১ আগস্টকে ৩২ জুলাই হিসেবে গণনা করে দৃশ্য মাধ্যমের ব্যানারে অনেক শিল্পী পেথে এক হন আবার। ততদিনে সারা দেশে নেটওয়ার্ক বন্ধ সহ হয়ে গেছে আরও নৃশংস হামলা।
এসময়ে আলোচনায় চলে আসেন আজমেরী হক বাঁধন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় নিজের সন্তানের উদ্ধৃতি দিয়ে হত্যার বিচার দাবী করেন ও গুলি চালানোয় নিন্দা প্রকাশ করেন। এরপর তাকে দেখা গেছে আরও কয়েকবার। তাকে দেখা গেছে ৩ আগস্ট তথা ৩৪ জুলাই শহীদ মিনারের বিশাল জমায়েতে।
৫ আগস্ট তথা ৩৬ জুলাইয়ে তাকে দেখা গেছে বিজয় উল্লাসে রাস্তায় নেমে পড়তে। এরপর তাকে মেয়েকে সাথে নিয়ে রাস্তায় টহল দিতেও দেখা গেছে যখন ডাকাতি হবার সম্ভাবনা দেখা যায়। ১০ আগস্ট শহীদ মিনারে তাকে দৃশ্যমাধ্যমের ব্যানারে আবারও দেখা যায় নিজেদের চাওয়া পাওয়া নিয়ে আশা ব্যক্ত করতে। এরমাঝে সবসময়ই সোশাল মিডিয়াতে সোচ্চার ছিলেন তিনি।
আরমীন মুসার কথা না বললেই নয়। ব্যারিস্টার মানজুর আল মতিন পিতমের আহবানে ৩০ জুলাই মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় প্রতিবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের উদ্যোগে এক প্রতিবাদী গানের মিছিলের আয়োজন করা হয়। সেখানে আরমীন মুসা সবান্ধবে অংশগ্রহণ করেন। সামাজিক মাধ্যমে সরব থাকার পাশাপাশি তিনি দৃশ্যমাধ্যমের সকল আয়োজনে থেকে রণ সঙ্গীতে তালে তাল মিলিয়েছেন।
৩ আগস্ট ব্যান্ড শিল্পীদের জমায়েত থেকে মিছিল করে শহীদ মিনার যাওয়ার পথে তালে তাল মিলিয়েছেন। গান তো বটেই – ছিলেন সরব শ্লোগানেও। ১০ আগস্ট ছবির হাটে র্যাপার হান্নানসহ অন্য র্যাপারদের আয়োজনেও শুরুতে তাকে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনা করতে দেখা যায়। দল-মত নির্বিশেষে সুরে সুরে সত্য বলার নেশা থেকেই আরমীন ছুটে গেছেন পথে।
পরিচালক সাবরিনা আইরিনও ছিলেন ১৯ তারিখ থেকেই রাজপথে। কারফিউ দেওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে কালো পোশাক পরে ছিলেন পথে। ছিলেন ফার্মগেটের শিল্পীদের জাময়েতে। ছিলেন প্রতিবাদের সকল আয়োজনে।
বন্ধনের সেই সানজিদা প্রীতি নীরবেই মিছিলে সামিল হয়েছেন বারবার। ১৯ জুলাইয়ের সেই াগো বাহে কোনঠে সবাই-শিরোনামের জমায়েত থেকে শুরু হরে ৩০ জুলাই, ২ আগস্ট ধানমণ্ডির শিল্পী সমাজের প্রতিবাদ- সব মিছিলেই তাকে দেখা গেছে। তিনি গানে শ্লোগানে ছিলেন মুখর।
আরেক নির্মাতা তানহা জাফরিনকে দেখা গেছে সব মিছিলে সামনের সারিতে। ৩ আগস্টের রবীন্দ্র সরোবরের আয়োজন থেকে শুরু করে মিছিলে, শ্লোগানে তাকে দেখা গেছে শিল্পীদের সকল প্রতিবাদের মিছিলে।
উপস্থাপক সোনিয়া রিফাত যে শুধু সামাজিক মাধ্যমে বিপ্লব নিয়ে স্বোচ্চার ছিলেন, তা নয়, বরং তিনি সচেতনতামূলক পোস্ট করেছেন অনেক বেশি। সত্য খবর প্রচার ও প্রসার, আন্দোলন পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা- সবকিছুতেই সোনিয়ার ছিল আন্তরিক পদচারণা। তার বলিষ্ঠ আচরণ সকলকে আকৃষ্ট করেছে আরেকবার। এমন কী তিনি এটাও বলেন- ভবিষ্যতে হয়তো এ কারণে অনেকের সাথে তার কাজও করা হবে না।
ছাত্রদের উপর যিখন নির্মমভাবে নির্যাতন চলছে, অবাধে চলছে গুলি তখনই পারসা মেহজাবীন পূর্ণি এক গানে বাজিমাত করেন। সেই গানে তিনি জুলাই মাসের বিবরণ তুলে ধরেন সুন্দরভাবে। পারসার এই সাহসী উদ্যোগের কারণে বাহ্বা পেয়েছেন তো বটেই, গানটি অনেকের কাছে অনুপ্রেরণারও ছিল। পথে- গানে পারসার এই আলোচনায় আসাতে তাকে অনেকেই শুভ কামনা জানিয়েছেন।
এবারের মনে করিয়ে দিয়ে হবে আরেক সাহসী কণ্ঠকে। তিনি হলেন জাকিয়া বারী মম। তাকে মিছিলে – শ্লোগানে ছিলেন মুখর। তবে তার প্রতিবাদ আরও শক্ত অবস্থানে আসে শিল্পী সংঘ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর।
২ আগস্ট উত্তরাতে ম্যাসাকারের পর তিনি সামাজিক মাধ্যমে জানান দিয়ে শিল্পী সংঘ থেকে অব্যাহতি নেন। কারণ হিসেবে সংঘের এমন অবস্থায় নীরবতাকে উল্লেখ করেন।
১০ আগস্ট তাকেও শহীদ মিনারে একই ব্যানারে বাঁধনের পাশে দেখা যায়।
ছাত্র জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতন। প্রতিকূলতা পার করে নিজেদের সীমা নিজেরাই অতিক্রম করেছেন। এই তালিকাতে আরও আছেন রাফিয়াথ রশীদ মিথিলা, সাবিলা নূর, শ্রাবণী ফেরদৌস, ইদিলা কাছরিন ফরিদ তুরিন, মুমতাহিনা টয়া, এলিটা করিমসহ অনেকেই। আজ এই নারী যোদ্ধাদের সালাম। কারণ, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সেই কবেই বলে গেছেন “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর”।
লেখা: সৈয়দা ফারজানা জামান রুম্পা