ছেলে হত্যার বিচারের জন্য লড়াই করেছেন সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী
দেশের জনপ্রিয় অভিনেতা সালমান শাহ এর মরদেহ ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার ইস্কাটনে বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এটাকে আত্মহত্যা বললেও ২৯ বছর পরে গত সোমবার আদালত এটিকে হত্যা মামলা হিসেবে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন । দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে ছেলে হত্যার বিচারের জন্য লড়াই করেছেন সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী। সম্প্রতি দেশের এক গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে উঠে আসে তার নানা চিন্তা ও সংগ্রামের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক ইতিহাস। সাথে নানান পক্ষের হুমকির কথাও।

আদালত দেয়া হত্যা মামলার নির্দেশ নিয়ে জানতে চাইলে নীলা চৌধুরী বলেন, ‘দীর্ঘদিন পরে একটা ভরসার জায়গা তৈরি হলো। মামলার কার্যক্রম এত দ্রুত হয়ে যাবে ভাবিনি। এ জন্য শুকরিয়া। অনুভূতি আর কী বলব। আমার সমস্ত শরীর–মন খালি খালি মনে হচ্ছে। ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। ছেলেকে মার্ডার করা হয়েছে, মামলা হচ্ছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে অবশেষে ন্যায়বিচার পাব—এটাই ভালো লাগার কথা।
সালমান শাহ’র মায়ের লড়াই
নীলা চৌধুরিকে ২৯ বছর ধরে লড়তে হয়েছে, এই জার্নিটা কেমন ছিলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই ২৯ বছর কিছু মানুষ আমাকে খারাপ বলেছে। আমার ছেলেকে খারাপ বলেছে। আমার জন্য ছেলে মারা গেছেন, সেটাও শুনতে হয়েছে আমাকে। লালনপালন করে বড় করে আমি নাকি আমার ছেলেকেই মেরেছি, এটাও আমাকে শুনতে হয়েছে। আমাকেই দায়ী করেছে সামিরা, আজিজ, ডনরা। কিন্তু ২৯ বছর ধরে আমার বিশ্বাস ছিল, আইনে একদিন প্রমাণ হবে এটা খুন। আদালত যেভাবে সোমবার ঘটনাটা উপস্থাপন করেছেন, সেখান থেকে আমাকে যেভাবে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে; সেটা আমাকে মানসিকভাবে শান্তি দিয়েছে।

তাকে এই পুরো সময়টাকে কেউ ভয়ভীতি দেখিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই এক মাস আগেও ডন আমাকে হুমকি দিয়েছে। প্রেসক্লাবের সামনে যেতে বলেছে। চিন্তা করা যায়, যে আমার ছেলের পিছে পিছে ঘুরত। সাহস পেত না আমাদের সঙ্গে কথা বলার। সেই ডন কত বড় ব্যাকআপ থাকলে আমাকে হুমকি দিতে পারে।‘
এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মামলার সুরাহা না হওয়ার মূল কারণ কী ছিল এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা আপনারাই, সাংবাদিকেরা, ভাইবোন যারা মিডিয়াতে আছেন তারা ভালো জানেন। আজিজ মোহাম্মদের টাকা দিয়ে; সালমানকে দুশ্চরিত্র, লম্পট; সামিরার সঙ্গে গন্ডগোল, শাবনূরের সঙ্গে প্রেম—এগুলো বানিয়ে বানিয়ে খবরে রটিয়ে ইমনকে পাগল করতে চেয়েছিল। এর পেছনে সেই সময়ের মিডিয়ার একটা বিরাট সিন্ডিকেট কাজ করেছে। তারা চায়নি সত্যটা সামনে আসুক। তারা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে বিচারপ্রক্রিয়া।‘

মায়ের জবানে সালমান শাহ ও তার স্মৃতি
ছেলে সালমান শাহর কোন কথা বা স্মৃতি বেশি মনে পড়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘সব সময় কিছু একটা হলেই সালমান তার বাপকে বলত মিস্টার নেগেটিভ, আর আমাকে বলত নেত্রী। বাসায় বাচ্চাদের মতো থাকত। রাতে ও প্রায়ই আমার কাছে এসে বসত, শুয়ে থাকত, পায়ের কাছে মাথা রাখত। কখনো মাথায় তেল দিত। ওর সংসার নিয়ে কথা বলত। সেখানে অশান্তি ছিল। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলত। সামিরার কথা বলত, সে সারা দিন কষ্ট করে আসে, ক্লান্ত থাকে, তখন সামিরা তাকে অনেক বাজে কথা বলত। সে আমাকে এটাও বলছিল যে সামিরা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি রাগ করে বলছিলাম ‘ছেড়ে দে’। তখন ও বলছিল, ‘আম্মা, ও নিজেই চলে যাবে, আমার ছাড়ার দরকার হবে না। আমার ক্যারিয়ার নষ্ট হবে।’ সে ডিভোর্স নোটিশও দেওয়ার কথা বলেছিল। সে যেখানে ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছিল, সেখানে সালমান আত্মহত্যা করবে কেন? এই স্মৃতিগুলোই মনকে অশান্ত করতো বলে জানান তিনি।

ছবি: সংগৃহীত
সালমান শাহ এর খুনের চিহ্ন
কোন আলামত দেখে মনে হয়েছিল যে এটি খুন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘খুনের চিহ্ন আর আত্মহত্যার চিহ্ন আলাদা। সেটা তার শরীরেও ছিল। এটা খুন, বোঝাই যাচ্ছিল। প্রমাণও ছিল। সামিরার ঘনিষ্ঠরা পরে তো বলেই দিল কীভাবে খুন করেছে। এটা পরিকল্পিত খুন। সামিরা চিটাগং থেকে লোক এনেছে। এরাই অন্যদের সঙ্গে মিলে ইমনকে খুন করেছে। ওই বিল্ডিংয়ের অনেক ফ্ল্যাট ছিল আজিজ মোহাম্মদের ভাড়া করা। সেখানে তার লোকজন থাকত। ২৯ বছর ধরেই আমি বলে আসছি, আমার ছেলে আত্মহত্যা করার মতো ছেলে নয়। আরেকটা কথা, তখন সালমানের নিয়মিত শুটিং নিয়ে ব্যস্ততা ছিল। সেগুলো নিয়ে ছেলে খুন হওয়ার আগে আমাদের কথা হয়েছিল। এ ছাড়া আমি এতিমখানা দেব, খুনের আগের দিনও এতিমখানা করার প্ল্যান করছিলাম ছেলের সঙ্গে। সেই ছেলে কেন আত্মহত্যা করবে? আমি মুখস্থ বলে দিতে পারি, আমাদের কাছে সব সাক্ষী আছে।‘
আদালতের দেয়া নির্দেশের বরাত দিয়ে রাজধানীর রমনা থানায় সম্প্রতি সালমান শাহ হত্যা মামলা করেছেন তার মামা। এদিকে গণমাধ্যমে সম্প্রতি একটি জবানবন্দি প্রকাশিত হয়েছে যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে ১২ লাখ টাকার চুক্তিতে সালমান শাহকে হত্যা করা হয়। এর খুনের নেপথ্যে ছিলেন সালমানের স্ত্রী সামিরা, তার শাশুড়ীসহ অনেকেই। আসামী করা হয়েছে মোট ১১ জনকে।