ক্ষণজন্মা সংগীতশিল্পী হ্যাপি আখান্দ
বাংলা গানের ইতিহাসে এমন কিছু সুর আছে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকে। “আবার এলো যে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে / চলো না ঘুরে আসি অজানাতে, যেখানে নদী এসে থেমে গেছে” এমনই এক কালজয়ী গান, যা শুনলেই মনে পড়ে যায় অমর শিল্পী হ্যাপি আখান্দের কণ্ঠ। আজ, ১২ অক্টোবর, এই ক্ষণজন্মা গায়কের জন্মদিনে ফিরে দেখা যাক তাঁর জীবন, সঙ্গীত, আর সেই কালজয়ী গানের জন্মকথা।
সংগীত পরিবারে জন্ম
পুরান ঢাকার পাতলা খান লেনে ১৯৬০ সালের ১২ অক্টোবর জন্ম নেন অর্চিতা স্পর্শিয়া নয়, বরং বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র হ্যাপি আখান্দ। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন পার্সিয়ান বংশোদ্ভূত, যাদের পদবি ছিল ‘আখান্দজাদে’। পরিবারের সংগীতপ্রেমই তাঁকে ছোটবেলা থেকেই সুরের পথে নিয়ে আসে। বাবা ছিলেন সংগীতানুরাগী, আর বড় ভাই লাকী আখান্দ ছিলেন তার প্রথম ও প্রধান শিক্ষক।
সহজাত সংগীতপ্রতিভা
অল্প বয়সেই হ্যাপির সংগীত প্রতিভা সবার নজর কাড়ে। তিনি ছিলেন স্বভাবজাত শিল্পী গিটার, পিয়ানো বা তবলা , যা-ই হাতে নিতেন, তাতে এক অনন্য সুরের ঝংকার ছড়িয়ে দিতেন। সংগীতজগতে তাঁর এমন বহুমুখী দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন সমসাময়িক শিল্পীরা।
সংগীতযাত্রার শুরু
মাত্র ১০ বছর বয়সে গিটারের তাল ধরেন তিনি। বড় ভাই লাকীর গিটার বাজানো দেখে গোপনে শেখা শুরু করেছিলেন। একদিন লাকীর কাছে ধরা পড়েন, এরপর থেকে কনসার্টে বড় ভাইয়ের ব্যান্ডে বাজাতে শুরু করেন। স্বাধীনতার পর ‘স্পন্দন’সহ একাধিক ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হন হ্যাপি। আজম খান ও লাকী আখান্দের সঙ্গে টিএসসির কনসার্টে পারফর্ম করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’ নামের ব্যান্ডে যোগ দেন, যা স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম প্রথম ব্যান্ড হিসেবে পরিচিত।
১৯৭৯ সালে হামিন, শাফিন ও অন্যদের সঙ্গে গড়ে তোলেন ‘মাইলস’। সেই সময় থেকেই এই ব্যান্ড বাংলাদেশের আধুনিক সংগীতজগতে বিপ্লব ঘটায়।
‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’র জন্ম
বাংলাদেশি সঙ্গীত ইতিহাসে হ্যাপি আখান্দের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান নিঃসন্দেহে “আবার এলো যে সন্ধ্যা”। গানটি লিখেছিলেন এসএম হেদায়েত, সুর করেছিলেন লাকী আখান্দ।
নওগাঁর জমিদার মামুনলাল চৌধুরীর বাড়িতে এক বিকেলে বেড়াতে গিয়ে গানটির জন্ম। লাকীর স্মৃতিচারণ অনুযায়ী ,
“লাল শাড়ি পরে বেদে মেয়েরা হাঁটছিল, আকাশে রঙিন মেঘ। আমি হেদায়েতকে বললাম, একটা গান লিখ না। কিছুক্ষণ পর ও বলল—‘আবার এলো যে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে’। তারপর লিখল—‘চলো না ঘুরে আসি অজানাতে, যেখানে নদী এসে থেমে গেছে।’”
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম রেকর্ড হয় গানটি। পরে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকির চলচ্চিত্র “ঘুড্ডি” তে ব্যবহৃত হয় এটি। সমুদ্রের পাড়ে রাইসুল ইসলাম আসাদ ও সুবর্ণা মোস্তফার দৃশ্যায়ন গানটিকে দেয় এক অনন্য আবেগের রূপ, যা আজও শ্রোতাদের মনে অম্লান।
অল্প বয়সেই অমরত্ব
মাত্র ২৭ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান হ্যাপি আখান্দ। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট সংগীত আজও বেঁচে আছে কোটি মানুষের হৃদয়ে।
হ্যাপি আখান্দের জনপ্রিয় গানসমূহ :
- আবার এলো যে সন্ধ্যা
- কে বাঁশি বাজায় রে
- খোলা আকাশের মতো
- নীল নীল শাড়ি পরে
- পাহাড়ি ঝরনা
- এই পৃথিবীর বুকে
- স্বাধীনতা তোমায় নিয়ে
- তোমায় পেয়ে ফুরালো
এছাড়া ফেরদৌস ওয়াহিদের ‘এমন একটা মা দে না’ এবং ফিরোজ সাঁইয়ের ‘ইশকুল খুইলাছে রে মাওলা’, এই দুই গানের সংগীত পরিচালনাও করেন হ্যাপি আখান্দ।
উত্তরাধিকার
যদিও তাঁর জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু সৃষ্টিগুলো অমর। আজও ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ বাজলে, যেন ফিরে আসে সেই সোনালি সময়, যখন দুই ভাই লাকী ও হ্যাপি আখান্দ বাংলা গানের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় লিখছিলেন।