বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে ২০২৪। দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বছর ২০২৫। জীবনের ভ্রমণ শেষ করে এ বছরও বিনোদন অঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কয়েকজন গুণী চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। কীর্তিমানের মৃত্যু নেই- আছে ছেড়ে যাওয়ার পরেও তাদের প্রতিচ্ছবির প্রতিফলন। চিত্রালীর স্পেশাল ফিচার এবারের তাদের নিয়েই।
আহমেদ রুবেল
গত ৭ ফেব্রুয়ারি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান নন্দিত অভিনেতা আহমেদ রুবেল। ওইদিন সন্ধ্যায় বসুন্ধরা সিটির বেজমেন্টে গাড়ি রেখে নিজের শেষ সিনেমা ‘পেয়ারার সুবাস’-এর প্রিমিয়ার অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তিনি। গাড়ি থেকে নামার পর ফ্লোরে পড়ে যান এই অভিনেতা। এরপর তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিজের শেষ সিনেমা মুক্তির একদিন আগে মারা যান এই অভিনেতা।
খালিদ সাইফুল্লাহ
এ বছরের ১৮ মার্চ মারা যান আশি ও নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী, ‘চাইম’ ব্যান্ডের ভোকালিস্ট খালিদ। খালিদের আকস্মাৎ চলে যাওয়ায় সঙ্গীতাঙ্গনে শোক নেমে আসে। তার গান যেমন চির নবীন, তার জীবন যাপনেও ছিল তারুণ্যের ছোঁয়া। তার উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আছে ‘কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে, ‘যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে’।
শাফিন আহমেদ
এ বছরের ২৫ জুলাই সবাইকে হঠাৎ করেই চলে গেলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলসের ভোকাল, সুরকার ও গীতিকার শাফিন আহমেদ। আমেরিকায় একটি আয়েঅজনে অংশ নিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। দেশে ফিরে আসেন নিথর দেহে। বাংলাদেশের রক গানের জগতকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন এই তারকা কণ্ঠশিল্পী। তিনি এবং তার ‘ফিরিয়ে দাও’ গানটি ভক্তের মনে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন চিরদিন। বাংলা ব্যান্ডের জগতের নিঃসন্দেহে কিংবদন্তী শিল্পী তিনি।
মনি কিশোর
চলতি বছরের অক্টোবরে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ৯০ দশকের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মনি কিশোর। ১৯ অক্টোবর রাজধানীর রামপুরার বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মনি কিশোর একটি সময়ে রেকোর্ড সংখ্যক গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন্ তোর মৃত্যুর কারণ অজানা এখনও।
মনোজ মিত্র
এ বছর চলে গেলেন আরও এক কিংবদন্তি অভিনেতা ও নাট্যকার মনোজ মিত্র। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার ধূলিহার গ্রামে ১৯৩৮ সালের ২২ ডিসেম্বর মনোজ মিত্রের জন্ম। ১২ বছর বয়সে তিনি ভারত পাড়ি জমান। ১৯৫৯ সালে তিনি প্রথম নাটক লিখেন, যার নাম ‘মৃত্যুর চোখে জল’।
হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল
এ বছরের ৩০ জুলাই সংগীতশিল্পী, নির্মাতা ও সঞ্চালক হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল দীর্ঘদিন অসুস্থতার সাথে যুদ্ধ করে দেহ ত্যাগ করেন। ২০১১ সালে জুয়েলের লিভার ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর থেকে নিয়মিত ভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতেন তিনি। ১৯৯২ সালে প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ হয় তার। দশটির মতো অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন তিনি। তবে বেশি পরিচিতি লাভ করে ‘এক বিকেলে’ অ্যালবামটি। অ্যালবামটি জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর গায়কের নামই হয়ে যায় ‘এক বিকেলের জুয়েল’। আরেক প্রয়াত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর সাথে তার কণ্ঠের মিল ও গাঢ় সম্পর্ক থাকায় তাদের জুটির কিছু দারুণ গান আছে বাংলাদেশে গানের খাতায়।
সাদি মহম্মদ
বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, শিক্ষক ও সুরকার সাদি মহম্মদ এ বছরের ১৪ মার্চে নিজ বাসায় আত্মহত্যা করেন। তার বাবা সলিমউল্লাহ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তার বাবার নামেই ঢাকার মোহাম্মদপুরের সলিমউল্লাহ রোডের নামকরণ করা হয়েছে। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার।তার মৃত্যুর পেছনের কারণ জানা যায়নি। তবে তার ছোট ভাই শিবলী মহম্মদের বয়ানে ধারণা করা হয়, কর্মক্ষেত্রে মূল্যায়ণে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না এবাং মা মারা যাবার পর থেকে অবষাদের ভুগছিলেন। যার ফলে অকালে একজন কিংবদন্তী শিল্পীকে হারালো বাংলাদেশ।
বিজয় খারে
এছাড়াও বিনোদন জগৎ হারিয়েছে ভোজপুরি সিনেমার ‘গব্বর সিং’ খ্যাত প্রবীণ অভিনেতা বিজয় খারে’কে। গত ১৫ ডিসেম্বর মারা যান তিনি। ২০০টিরও বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন এ অভিনেতা। অভিনয় প্রশিক্ষণের জন্য ‘বিজয় খারে অ্যাকাডেমি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানও পরিচালনা করেতেন এ অভিনেতা।
অলিউল হক রুমি
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা অলিউল হল রুমি মারা যান। মৃত্যুর আগে শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে সবার কাছে দোয়া চেয়েছিলেন এই অভিনেতা। ক্যানসার জয় করে আগের মতো অভিনয়ে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেরা হয়নি তার।
মাসুদ আলী খান
পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে প্রায় ৫০০ নাটকে অভিনয় করে বাংলা নাটক জগতের কিংবদন্তি হয়ে উঠা অভিনেতা মাসুদ আলী খান মারা গেসেন গত পহেলা নভেম্বর। মঞ্চে অভিনয় দিয়ে শুরু তার এই দীর্ঘ ক্যারিয়ারের। ঢাকায় টেলিভিশন কেন্দ্র চালু হওয়ার পর ছোট পর্দায় অভিষেক। চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও নজর কেড়েছেন ক্ষণে ক্ষণে।
পাপিয়া সারোয়ার
এ বছরের ১২ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন কণ্ঠশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার। তার মৃত্যুতে দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তিনি মূলত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। তবে তার কণ্ঠে একবার ‘নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন, নাইরে টেলিগ্রাম’ গানটি প্রচারিত হওয়ার পর তাকে সেই গানের জেরেই অনেক শ্রোতা ভালোবাসা জানিয়েছেন সারা জীবন।
কার্ল ওয়েদার্স
২ ফেব্রুয়ারিতে মারা গেলেন, বিশ্বজুড়ে তুমুল জনপ্রিয় মুভি সিরিজ ‘রকি,‘প্রিডেটর’ ও ‘স্টার ওয়ারস’এর জনপ্রিয় অভিনেতা কার্ল ওয়েদার্স। ‘রকি’ সিনেমায় সিলভেস্টার স্ট্যালন, প্রিডেটরে আরনল্ড শোয়ার্জনেগার ও স্টার ওয়ারসের হ্যারিসন ফোর্ডের সঙ্গে কাজ করেন এই গুণী অভিনেতা। তার মৃত্যু একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি টেনে আনলো হলিউড জগতে।
ওস্তাদ জাকির হোসেন
সংগীত জগতের আরেক নক্ষত্র ভারতের কিংবদন্তি তবলাবাদক ওস্তাদ জাকির হোসেন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর একটি হাসপাতালে গত ১৬ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ফুসফুসের রোগে ভুগতে থাকা এই কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে এই শিল্পীর সম্পর্ক সুরের। কনসার্ট ফর বাংলাদেশের আয়োজনের অন্যতম শিল্পী ছিলেন তিনি। এদেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আয়োজনে অংশও নিয়েছিলেন ওস্তাদ জাকির হোসেন।
শ্যাম বেনেগাল
২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় চিরবিদায় নিলেন বলিউডের কিংবদন্তি নির্মাতা ও ভারতের প্যারালাল সিনেমার অন্যতম পথিকৃৎ ৯০ বছর বয়সে মুম্বাইয়ের ওয়াকহার্ট হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ তিনি। শ্যাম বেনেগাল।
১৯৭০ ও ১৯৮০ দশকে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতকে তিনি উপহার দিয়েছেন ‘মন্থন’, ‘অংকুর’, ‘ভূমিকা’, ‘জুনুন’, ‘মান্ডি’, ‘নিশান্ত’ সহ বহু ছবি। সর্বশেষ শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বায়োপিক বানিয়েছিলেন তিনি। হিন্দিতে সেরা ফিচার ফিল্মের জন্য সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি, সেই সঙ্গে ভূষিত হয়েছেন পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ এবং দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারেও।
এছাড়াও এবছর মৃত্যু বরণ করেন ,স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগীতযোদ্ধা, সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যাম,ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী আফরোজা হোসেন,বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও শিক্ষক আবু জাফর, অর্থহীন ব্যান্ডের সাবেক গিটারিস্ট মিনহাজ আহমেদ পিকলু সহ আরো অনেকে। তাদের চলে যাওয়াও রেখে গেছে কাজের স্বর্ণালী ইতিহাস। এজন্যই কবি বলেছেন,
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।
তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,
চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল–
তুলে নিল দ্রুতরথে
দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
তোমা হতে বহুদূরে।