মহান মুক্তিযুদ্ধের দ্বাদশ সেক্টর হিসেবে পরিচিত ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আর একবিংশ শতাব্দীতে এসে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকাই যেন পালন করলো ‘ইন্টারনেট’।
তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে এই শতাব্দীতে হাজির হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। অর্থাৎ, ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, এক্স-এর মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। আর এই মাধ্যমগুলোতে গত কয়েক বছরে উত্থান হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের।
স্বভাবতই ইনফ্লুয়েন্সার মানে সাধারণ মানুষেরা যা বুঝে থাকেন, তা হলো ‘প্রভাব ফেলেন এমন ব্যক্তি’।
যুক্তি-তর্কের হিসেবে অনেক ইনফ্লুয়েন্সারই নিজেদের এই শব্দে আখ্যায়িত করতে চান না। তারা দাবি করে থাকেন- তারা হলেন কনটেন্ট ক্রিয়েটর, কিংবা ইউটিউবার। তাদের দাবি দাওয়া যাই হোক না কেন, গেলো দুই মাস ধরে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ট্রানজিশনের সময় প্রকৃত রুপেই ইনফ্লুয়েন্স করেন এমন কয়েকজনের দেখা পেয়েছেন বাংলাদেশিরা। আন্দোলনে যারা রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
কথা যখন কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের নিয়ে, তখন একটি নাম উদয় হয় সবার মনে। তিনি হলেন সালমান মুক্তাদির। যিনি ব্যাড বয় ইমেজ পেছনে ফেলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বীরের বেশে হাজির হয়েছেন। তবে চিত্রালীর আজকের ফিচার সালমান মুক্তাদিরকে নিয়ে নয়, আজকের ফিচার সেই ইনফ্লুয়েন্সারদের নিয়ে যারা দেশীয় সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশের মানুষের প্রতিবাদের ভাষা আন্তর্জাতিকভাবে মানুষের হাতের মুঠোয় পৌঁছে দিয়েছেন।
এ তালিকার শুরুতেই আসে জার্মানিতে বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত কনটেন্ট ক্রিয়েটর আকাশ ব্যানার্জির নাম। যিনি সুপরিচিত ‘দ্য দেশভাক্ত’ নামের ইউটিউব চ্যানেলের কারণে। এই চ্যানেলটিতে তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করে থাকেন সাড়া বিশ্বের বিভিন্ন ‘হট টপিক’। বিষয়গুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তিনি সত্যকে উপস্থাপন করেন। যেমনটি তিনি করেছেন বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময়।
বাংলাদেশের আন্দোলন নিয়ে আকাশ ব্যানার্জি তিনটি পার্টে তিনটি ভিডিও প্রকাশ করেন।
প্রথম পার্টের শিরোনাম- ‘Bangladesh On Boil | What Is ‘Dictator’ Sheikh Hasina Afraid Of’। যা প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালের ২৩ জুলাই। যখন দেশীয় মিডিয়ার ছিল সত্য প্রকাশে সীমাবদ্ধতা, তখন আকাশের ভিডিওটি সাড়া বিশ্বের জন্য সত্য জানার একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।
‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার!’ রক্ত গরম করা এই শ্লোগান দিয়ে শুরু হওয়া ভিডিওটিতে আকাশ বলেন, ‘বাংলাদেশের রাস্তায় প্রতিবাদে নেমেছিল অনেক শিক্ষার্থী। সড়কে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। স্পেশাল ফোর্স নিয়োজিত রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে হেলিকপ্টারে স্পেশাল ফোর্স নামানো হয়। তরুণদের কেউ কেউ এখন মৃত। আহত হাজার হাজার। একে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সব বড় হত্যাযজ্ঞ।’ কোটা পদ্ধতি নিয়েও খুঁটিনাটি তুলে ধরেন তিনি। কোটা আন্দোলনের বিপরীতে কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন আকাশ ব্যানার্জি।
এই কনটেন্ট ক্রিয়েটরের বাংলাদেশ নিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভিডিও দুটির শিরোনাম ছিল যথাক্রমে- ‘Can Dictator Sheikh Hasina Survive Student Protests In Bangladesh?’ এবং ‘Last 48 Hours Of Dictator Sheikh Hasina | What Next For Bangladesh?’। তৃতীয় ভিডিওটি প্রকাশিত হয় ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পর।
ভিনদেশী প্রতিবাদী ইনফ্লুয়েন্সারদের তালিকায় দ্বিতীয় নামটি হলো সোশ্যাল মিডিয়ার সেনসেশন ভারতীয় ইউটিউবার ধ্রুব রাঠী। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন নিয়ে তিনিও ছিলেন সক্রিয়। ২৬ জুলাই প্রকাশিত তার ‘Bangladesh is Burning! | Sheikh Hasina called a Dictator | What’s Happening?’ শিরোনামের ভিডিওটি আন্দোলনের সময় বেশ সাড়া জাগিয়েছিল নেট দুনিয়ায়। তিনি সেই ভিডিও বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া থেকে শুরু করে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
ধ্রুব রাঠী বলেন, ‘ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সামরিক কারফিউ ঘোষণা করা হয়। রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস আর সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে পুলিশ। জনসংখ্যা ও সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিতে কোটার সংস্কার চেয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ২০১৮ সালেও কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন তারা। সে সময় নির্বাহী আদেশে কোটা ব্যবস্থা বাতিল হয়।‘ আন্দোলনকারীদের ন্যায্য দাবি সহিংসতা দিয়ে দমানোর প্রয়োজন ছিল না বলে মনে করেন তিনি।
এবারে যাদের নাম আসে, তারা হলেন পোল্যান্ডের জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর এগোন হেয়ার এবং কোরিয়ান কনটেন্ট ক্রিয়েটর দাউদ কিম।
এগোন হেয়ার পরিচিত তার চ্যানেল ‘প্রজেক্ট নাইটফল’-এর জন্য। এই সেই চ্যানেল যেখানে দুই বছর আগে ভিডিও প্রকাশিত হয়েছিল ‘Bangladesh is the Worst country in the World’ শিরোনামে। এর দুই বছর পর বাংলাদেশের আন্দোলনের সময় এই চ্যানেল থেকেই প্রকাশিত হয় ‘Meet The Bangladeshi Students Making History’ শিরোনামের একটি ভিডিও।
এদিকে ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হয়ে আলোচনায় আসা ইউটিউবার দাউদ কিমও একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও প্রকাশ করে জানান, তিনিও আছেন বাংলাদেশি স্টুডেন্টদের পাশেই।
মূলত এই ভিনদেশী প্রতিবাদী ইনফ্লুয়েন্সাররাই আন্দোলনের সময় সাপোর্ট সিস্টেম হিসেবে কাজ করেছেন আন্দোলনকারীদের। সত্য এক না একভাবে সামনে আসবেই- তাদের থেকে এই আশার আলোই পেয়েছিলেন বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা। একারণেই বাংলাদেশের নব যুগের সূচনায় তাদের অবদানও অস্বীকার করার উপায় নেই… অস্বীকার করছেনও না বাংলাদেশের জনতা…।
লেখা: রাহনামা হক