যে মাসে জন্ম, সেই মাসেই মৃত্যু। ভক্তরা যখন দিন গুনছিল তাদের স্বপ্নের নায়কের ২৫তম জন্মদিন পালন করার, তার ঠিক ১২দিন আগে ৬ সেপ্টেম্বর চিরবিদায় জানান অভিনেতা মোহাম্মদ শাহরিয়ার (ইমন) ওরফে সালমান শাহ। তিনি বেঁচে থাকলে আজ ঢালিপাড়ার চিত্র হতো অন্যরকম। কারণ আজ ১৯ সেপ্টেম্বর, এই কীর্তিমানের জন্মদিন!
বাংলা সিনেমার উজ্জ্বল অধ্যায়ের প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেছিলেন যিনি, তিনি চলে যাওয়ার সময় রেখে গেছেন হাজারো ভক্তের মনে উঁকি দেওয়া অনেক অনেক প্রশ্ন। সাথে রেখে গেছেন অমীমাংসিত এক রহস্য! বাস্তব জীবনও যেন সিনেমার গল্প। তবে এই গল্প ভিন্ন আঙ্গিকের- ধরে নেওয়া যায়, মিস্ট্রি ঘরানার এক সিনেমার গল্প।
একথা কেন বলা হচ্ছে? ক্ষণজন্মা নায়ক সালমান শাহ’র জন্মদিনে আজ চিত্রালী সেই মিস্ট্রি নিয়েই কথা বলবে…
আজ থেকে ২৭ বছর আগের কথা। সালটা ছিল ১৯৯৬। সেবছর সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখ ছিল ছুটির দিন, শুক্রবার। সেদিন সকালে হঠাৎ ঢালিউড অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। কারণ ঐদিন ঢাকার ইস্কাটনে নিজ বাসায় ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় সালমান শাহ’র মরদেহ।
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বপ্রথম অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি করেন সালমানের বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই এটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করার আবেদন করা হয়। শুরু হয় তদন্ত। কিন্তু ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি), বিচারবিভাগীয় তদন্ত ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে প্রমাণিত হয়- হত্যা নয় আত্মহত্যা করেছেন সালমান।
এই তদন্ত রিপোর্টটির ঘোর বিরোধী চিত্রনায়কের মা নিলুফার চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরী। এমনকি বিষয়টি মানতে নারাজ নায়কের অগণিত ভক্তরাও।
সালমান কোনোভাবেই আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে নির্ঘাত হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি তার মায়ের। তার ভাষ্যমতে, তার ছেলের হত্যার পেছনে জড়িত আছেন তার স্ত্রী সামিরা হক, আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ফিল্মের আরও অনেকে। ফলশ্রুতিতে ছেলের মৃত্যুর পর বহুবার আমৃত্যু লড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন নীলা চৌধুরী। তার স্বামীও তাদের ছেলে হত্যার বিচার চেয়েছিলেন, কিন্তু সঠিক বিচার দেখে যেতে পারেননি। তাও তো এখন অবধি চলছে লড়াই। সালমানের মা-ও যদি মারা যান, তাও চলতে থাকবে এই মামলা। ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত নায়কের মায়ের পর ভক্তরাও এই লড়াই করে যাবেন বলে বিশ্বাস নীলা চৌধুরীর।
ফিরে যাওয়া যাক মামলার ব্যাপারে-
সালমানের বাবা যখন অপমৃত্যুর মামলা হত্যা মামলায় রুপান্তরের আবেদন করেছিলেন, তখন আদালত কর্তৃক বিষয়টি নিয়ে একসাথে তদন্ত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তারপর সিআইডি চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করেন ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর। এই প্রতিবেদনে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয় সালমানের মৃত্যুকে। এরপর ২৫ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে গৃহীত হয় চূড়ান্ত প্রতিবেদন।
সিআইডির প্রতিবেদন গ্রহণ করতে অস্বীকার করে রিভিশন মামলা দায়ের করেন সালমানের বাবা। এরপর পার হয়ে যায় কয়েকটি বছর। সালটা যখন ২০০৩, ঐ বছরের ১৯ মে আদালত কর্তৃক বিচারবিভাগীয় তদন্তে পাঠানো হয় মামলাটি। তখন থেকে প্রায় ১১টি বছর কেটে যায়। মামলাটিও আটকে থাকে একই জায়গায়- বিচার বিভাগীয় তদন্তে।
এরপর আসে ২০১৪ সাল। ঐ বছরের ৩ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। কিন্তু ফলাফল পাওয়া যায় একই। এই প্রতিবেদনেও সালমানের মৃত্যুকে অপমৃত্যু হিসেবেই উল্লেখ করা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে সেই বছরের ২১ ডিসেম্বর বিচারবিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেন চিত্রনায়কের মা। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি এই বিষয়ে নারাজি আবেদন দাখিল করেন।
নারাজি আবেদনটিতে আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ১১ জন তার সালমানের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারেন বলে উল্লেখ করা হয়। ফলশ্রুতিতে মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় র্যাবকে। র্যাবের তদন্তের আদেশের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল একটি রিভিশন মামলা করে রাষ্ট্রপক্ষ। রিভিশনটি ঐ বছরের ২১ আগস্ট মঞ্জুর করা হয় এবং র্যাবের কাছে আদেশ আসে মামলাটি আর তদন্ত না করার। এরপর মামলার দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয় পিবিআই-কে।
২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আলোচিত এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন তুলে ধরতে একটি সংবাদ সম্মেলন করা হয়। “সালমান শাহ হত্যাকাণ্ডের শিকার হননি, পারিবারিক কলহের জেরে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন”- ঐ সংবাদ সম্মেলনটি থেকে আবারও ফেরত আসে একই বক্তব্য। পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি পিবিআই থেকে ৬০০ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর পিবিআই-এর দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা খারিজ করেন আদালত। যার কারণে আবারও রিভিশন মামলা দায়ের করেন সালমানের মায়ের আইনজীবী ফারুক আহমেদ। পরের বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালের ১২ জুন সেই রিভিশনটি গ্রহণ করেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত।
দীর্ঘদিন ধরে চলা প্রিয় নায়কের কিংবা মায়ের প্রিয় ইমনের হত্যা মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার আসলেই কি পাবেন তার ভক্ত ও অনুরাগীরা? ঘটনাটি আসলেই কি হত্যা ছিল নাকি আত্মহত্যা? এই রহস্যের মীমাংসা হয়নি আজ পর্যন্ত।
তবে কীর্তিমানের যে মৃত্যু নেই, তা সালমান শাহ তার স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে খুব ভালোভাবেই প্রমাণ করে গেছেন। চলুক গল্প বাস্তবেও, মিস্ট্রির পাতা উল্টে যাক বা না যাক, সালমান শাহ’র জন্য আছে তার ভক্ত ও অনুরাগীরা চিরকাল। তাই আজও তারা গেয়ে বেড়ায়-
“নিজেকে আমি ভুলতে পারি
তোমাকে যাবে না ভোলা
তুমি মোর জীবনের ভাবনা
হৃদয়ে সুখের দোলা।”