একটা সময় পর্দার যেকোনও তারকা ছিলেন আসমানের নক্ষত্রের মতই। ধরা যেত না ছোঁয়া যেত না। পত্রিকার পাতায় যতটুকু শব্দে পরিচয়- ততটুকুই চেনার পরিধি। আজকাল সামাজিক মাধ্যমের কারণে সেই তারকার ঝলক যেন মুঠোফোনেই। আর সেকারণেই হয়তো ভাইটাল তারকা হয়ে যাচ্ছেন ভাইরাল, বা ভাইরাল তারকা বনে কেউ কেউ মেইনস্ট্রিম কাঁপিয়ে দিচ্ছেন। আজকের চিত্রালীর বিশেষ ফিচার ভাইরাল তারকাদের নিয়েই। বিশ্ব তো বটেই – তবে আলোচনার কেন্দ্রে থাকছে বাংলাদেশের ভাইরাল জগতই।
মনে পড়ে নব্বই দশকের কথা। যখন এমএমস অর্থ্যাৎ ভিডিও বার্তা শুরু হবার পর থেকেই আতঙ্ক শুরু হয়ে যায় চারপাশে। এই তারকার ভিডিও লিকড তো ওপাশে কোনও সাধারণ মানুষের। খুব বেশি দূরে না গেলেও চলে। পাশের দেশের রিয়া সেন এই লিকড ভিডিওর শিকার তা অনেকেই জানেন। আর সেকারণে তার ক্যারিয়ারও থমকে পড়ে। বাংলাদেশের প্রভার প্রাক্তণ প্রেমিকের লিক করা ভিডিওর কথা কে না জানেন। নানা টানাপড়েনের পর প্রভা ফের কাজ শুরু করেন।
এরপর সোশ্যাল মিডিয়া আসার পর ভীতিকর অবস্থাটা ধীরে ধীরে যেন সংকুচিত হতে থাকে। প্রসারিত হতে থাকে হঠাৎ জনপ্রিয়তা পাবার ইচ্ছা.. কেউ কেউ আবার নিজেও জানতেন না যে তিনি ভাইরাল হয়ে যাবেন।
যেমন ভারতের রানু মণ্ডল! রানু মণ্ডল। স্টেশনে গান গেয়ে একেবারে হিমেশ রেশমিয়ার সাথে গান গাইবার সুযোগও যেভাবে পেয়েছেন, আবার কিভাবে যেন কালের স্রোতে ভেসে হারিয়েও গেছেন।
সামাজিক মাধ্যম নিয়ে অনেক আলাপ হলেও এর সূচণা ধরা যেতে পারে রিয়েলিটি শোগুলোকে। নিজের ‘আসল’ রূপ দেখিয়ে আলোচনায় আসাকে অনেকে স্টারডাম মনে করেন। একারণেই এখন হয়তো রিয়েলিটি শোগুলোতে যেমন বিগবস, স্প্লিটস ভিলাতে অংশগ্রহণের সুযোগ পান অনেক ভাইরাল তারকা।
বাংলাদেশের রিয়েলিটি শো থেকে জনপ্রিয়তা পেয়ে তারকা বনে যান ক্লোজআপ ওয়ান খ্যাত নোলক বাবু ও বিউটি।
তবে তা রিয়েলিটি শোর মঞ্চ ছেড়ে ভাইরাল হবার ও করার আলাদিনের চেরাগ নিয়ে হাজির হয়ে সামাজিক মাধ্যম।
যদি বাংলাদেশের দিকে তাকানো যায়, এখন অবধি ভাইরাল মুখ হিসেবে এগিয়ে আছেন হিরো আলম। যেকোনও গানের কভার, সামাজিক মাধ্যমে অনেকের মতে ‘উদ্ভট’ উপস্থিতি তাকে আলোচনায় নিয়ে আসে। সকলে গাল’মন্দ করলেও – হিরো কী করছেন তা নিয়েও আলাপ করতেন। ফলে ভাইটাল ও ভাইরাস এই দুই শব্দের মিলে ভাইরাল হয়ে যান এই হিরো আলম। এমন কী রাজনীতিতে বেশ শক্তভাবেই লড়তে দেখা গেছে তাকে।
এরপরেও আলোচনায় আসে সেফু দা। তার অনলাইনে এসে যা খুশি তাই বলে সেফু দা মামলা মোকাদ্দোমরও শিকার হন।
ভাইরাল হলেও একটা ভিউ ভিউ খেলা জমে উঠে। তাই হয়তো এই স্ট্র্যাটেজি বুঝে অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হবার সুযোগটা লুফে নেয়। উনি ভাইরাল তো হয়ে গেলেন অমুকের ব্র্যান্ড ফেইস। তার ভিডিও- তো হয়ে গেলেন পরবর্তী ইভেন্টের শেঅ স্টপার।
তারকারাও এই সুযোগ নিয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনন্ত জলিলের সিনেমার কিছু অংশ আগে থেকেই ভাইরাল ছিল। বুক থেকে হৃদপিণ্ড বের করে আনার দৃশ্যের মত আরো অনেক তিছু। মূলত সামাজিক মাধ্যমের কারণেই তা হয়েছে। এর পর তার উচ্চারণ নিয়ে আলাপ হয়। তার স্ত্রী নায়িকা বর্ষাও ‘জুস’ বলে নেটপাড়ায় ভিউযুদ্ধে এগিয়ে যান।
কখনো মাহফুজুর রহমানের গান, কখনো কেকা ফেরদৌসীর নুডুলসের রান্না ভাইরাল হয়েছে। তবে ভাইরালে আজকালকার স্রোতে তাদের নিয়ে আলোচনা যেন অনেকটাই স্বাভাবিক।
বরং, যারা নিজেদের মেইনস্ট্রিম বলে দাবী করতেন, তারাই এখন ভাইরালের সুপার হিরো দর্শকদের কাছে। যেমন শাহরিয়ার নাজিম জয়, এবং জায়েদ খান। জাযেদ খান মূলত তার প্রতি নারীর প্রেম নিয়ে বক্তব্য দিয়ে ভাইরাল হয়ে পড়েন। ‘বালিশে ছবি’, রক্তে লেখা চিঠি – ইত্যাদি নিয়ে তার নানা সংলাপ ভাইরাল। বর্তমানে ডিগবাজি খান হিসেবে আছেন আলোচনায়। করছেন শো- দেশে বিদেশে।
শাহরিয়ার নাজিম জয়ের বিরুদ্ধে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করার অভিযোগ অনেকেরই। তার শোতেও অনেকে যেতে চান না- এটা গোপন খবর। এমনকী জায়েদ ও জয়ের কিছুদিন আগের মুখোমুখি ও অনস্ক্রিণ ‘পেটানো’র আলাপ সমালোচনারও জন্ম দেয়।
তবে এটা ঠিক, ভিউ বাণিজ্যের কারণে জয় গাড়ি ও বাড়ির মালিকও এতো কিছুর পরেও।
এমন কী বাংলা নাটকের ‘বদি’ আব্দুল কাদেরের নাতনি সীমরিন লুবাবাও ছোট বয়সে ‘কেন্দে দিয়েছি’ বলে আলোচনায় এসেছেন। হয়েছেন ভাইরাল মুখ। ফিতা কাটাসহ নানা শোতে তাকে দেখা যায়। সিনেমার অপু বিশ্বাসও গ্যাপের পর আলোচনায় থাকছেন সিনেমা নয় বরং ভাইরাল কমেন্ট করে। তা তাপস-মুন্নিকে নিয়ে হোক বা তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই হোক না কেন।
ভাইরাল যুদ্ধে যে কেবল সমালোচনা বা বেফাঁস মন্তব্য করলেই এগিয়ে যাওয় যাচ্ছে তা নয়। রাকীন আবসার বা ডানা ভাই জোশের মত অনেকেই তাদের অনলাইনের কন্টেন্ট দিয়ে এখনকার তারুণ্যের তারকা। নিজের গান ও স্টাইল দিয়ে তারকা ‘উরাধুরা’ ‘মালো মা’ গায়ক প্রীতম হাসান। মাশা ইসলামও ইউটিবেরই তারকা হিসেবে প্রথম মাৎ করেন। এর আগে বিনোদন জগতে তিনি থাকলেও ২০১৯ সালে ভারতের বম্বে জয়শ্রীর গাওয়া ‘জারা জারা’ গানটি নতুন করে গেয়ে আলোচনায় আসেন মাশা। এখন তিনি মঞ্চ ও প্লেব্যাকও করছেন ’ট্যাকা পাখি’ এই তারকা।
মূলত কোভিডের আমল থেকেই অনলাইনে নিজেদের প্রচার প্রসার নিয়ে তারকা তো বটেই, সাধারণ জীবন যাপনের অনেকেই ভিউতারকা হবার সুযোগ লুফে নেন। ‘ডালগোণা’ কফি হোক বা ডান্স নাম্বার – যার ভিউ বেশি তিনিই যেন তারকা। তবে অনেকেই দাবী করেন সমালোচনাকে অস্ত্র করে এই ভিউবাণিজ্যের অতিব্যবহার বা মতান্তরে অপব্যবহারেরও কমতি নেই। নানা ইভেন্টে অংশ নেওয়া অনেকেই আছেন সেই অভিযোগের শীর্ষে।
তবে গণমাধ্যমকেও অনেকে দুষছেন এই কারণে। যুক্তির লড়াইতে কে আগে আর কে পিছে তা না বিচার করা গেলেও সাংবাদিক সৈকত সালাহউদ্দিনের মতে, তারকাকে আকাশেই মানায়। যে ভাইরাল তিনি তো ভাইরালই।
সামাজিক মাধ্যমের তারকা আর ভাইরাল তারকারা এখন সমান্তরাল পথে চললেও, তাদের সাথে নাটক – সিনেমা- গান – তথাকথিত ‘মেইনস্ট্রিমের’ তারকা মিলেমিশে হয়ে গেছে যেন অসংখ্য লেনের মহাসড়ক। সবাই দৌড়াচ্ছে.. কিন্তু মোড় ঘুরতেই কে কোন পথে যাবেন বা ইউটার্নে ফিরে আসবেন আগের পথে- তা কেউ জানে না..
লেখা: রুম্পা সৈয়দা ফারজানা জামান