-মোঃ অলিউর রহমান
“আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি” গানটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে এক রাজকন্যার ছবি। যে রাজকন্যা একটা সময় রাজত্ব করেছেন ভারতীয় উপমহাদেশের রুপালি পর্দায়।
কিন্তু সব রাজকন্যার জীবনই কি সুখের হয়? কেননা এই রাজকন্যাকে তার স্বপ্নের রাজ্যকে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিতে হয়েছিল।
এই গল্পটি ভারতীয় উপমাহাদেশের ‘রূপনগরের রাজকন্যা’ অভিনেত্রী শবনমের। যার ঝুলিতে রয়েছে উর্দু, বাংলা ও পাঞ্জাবী ভাষায় নির্মিত ১৮০টি ছবি করার দুর্লভ ইতিহাস। তিনি এই পর্যন্ত অর্জন করেছেন ১৩টি নিগার পুরস্কার। যা যেকোন শিল্পীর জীবনে পরম পাওয়া। সর্বশেষ তাকে ২০১৯ সালে পাকিস্তানের লাক্স স্টাইল অ্যাওয়ার্ডসের মঞ্চে দেখা যায় আজীবন সম্মাননা পুরস্কার গ্রহণ করার সময়।
তার প্রকৃত নাম ঝর্ণা বসাক। জন্ম ১৯৪০ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায়। যেই রুপালি জগতের জন্যে তিনি ঝর্ণা থেকে শবনম হয়েছিলেন, সেই রুপালি জগতের খ্যাতিই তার ব্যক্তিগত জীবনে নিয়ে আসে অব্যক্ত বিপর্যয়।
অনেকেরই হয়ত জানা নেই বাংলাদেশী সিনেমায় ‘আম্মাজান’ খ্যাত আভিনেত্রীর ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে গেছে হৃদয়বিদারক ঘটনা। যে ঘটনার সাথে খোদ ‘আম্মাজান’ সিনেমার গল্পের সাদৃশ্য আছে।
দিনটা ১৯৭৮ সালের ১৩মে। স্থান- পাকিস্তানের লাহোরের অভিজাত এলাকা গুলবার্গ। পাকিস্তানের সমকালীন পত্র পত্রিকার বরাতে জানা যায়, সেদিন ৭ জন বন্দুকধারী পুরুষ আভিনেত্রী শবনমের বাসায় জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে। নগদ এক লক্ষ টাকা ও অলঙ্কার লুটপাটের পর তারা অভিনেত্রী শবনমকে তার সুরকার স্বামী প্রয়াত রবিন ঘোষ ও নয় বছরের ছেলে রনি ঘোষের উপস্থিতিতে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করে।
তথ্যমতে আসামিরা শবনমকে তার পেশার জন্যই নিজেদের শিকার হিসেবে বেছে নিয়েছিল। তখনকার পাকিস্তানের ক্রাইম রিপোর্টার জামীল চিশতী এর মতে, তখন ‘মার্শাল ল’ এর সময় ছিল। আসামিরা এতটাই নির্ভীক ছিল যে তারা এর পরিণামের কথা ভেবেও দেখেনি। তার ভাষ্যমতে, অভিযুক্ত আসামীদের প্রভাবে তখন স্থানীয় পুলিশ এই মামলায় শুধুমাত্র চুরি ও লুটপাটের মামলাই দায়ের করে। পুলিশ তখন ‘শারীরিক লাঞ্ছনা’ বিষয়ক মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
মামলায় অভিযুক্ত আসামীরা ছিলেন মোহাম্মদ ফারুক বান্দায়াল, ওয়াসিম ইয়াকুব ভাট, জামিল আহমেদ, তাহির তানভীর, জামশেদ আকবর সাহি, আঘা আকীল আহমেদ, মোহাম্মেদ মুযাফফার। অভিযুক্ত আসামীরা সবাই প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান ছিলেন। তখনকার সময়ে স্পেশাল মিলিটারি কোর্টে আভিযুক্তদের নিয়ে বিচার বসে। অভিজুক্তদের মধ্যে ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড তখনকার পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ জিয়া উল হক নিজে নির্ধারণ করেছিলেন। পরে পাকিস্তানের প্রখ্যাত আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী এসএম জাফরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ জিয়া উল হককে লেখা চিঠির বদৌলতে তাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়।
পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের মতে, ঘটনার পর থেকেই আভিনেত্রী শবনম তার একমাত্র ছেলে রনি ঘোষের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন। প্রথমে তার সন্তানের সুরক্ষার জন্য অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী রাখলেও পরে সন্তানকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা সবাই প্রভাবশালী পরিবারের হওয়ায় তিনি বিভিন্ন সময় মামলা থেকে সরে আসার জন্য হুমকি পেতেন।
ছেলের সাথে শবনম
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা মুক্তি পাওয়ার পর তার নিজের সন্তানের জন্য ভীতি আরও বাড়তে থাকে। ১৯৯৭ সালে তিনি সাংবাদিক শাহেদ নাসের চৌধুরীর সাথে শাহনূর স্টুডিওতে তার শেষ উর্দু ছবি “আউলাদ কি কসম” এর শুটিংয়ের সময় তাকে বলেন, “আমি নিজের একমাত্র সন্তানের সুরক্ষার কথা সবসময় চিন্তা করি। আমার পক্ষে এই ভয়ে এই দেশে থাকাটা আর সম্ভব নয়।”
এরপর শবনম ঢাকায় চলে আসেন। অভিনয় করেন তার জীবনের শেষ ছবিতে, যার নাম “আম্মাজান”। ভাগ্যক্রমে যে দুর্ঘটনা তার জীবনের চাপা কষ্ট হয়েছিল, সেই গল্পই হলো তার করা শেষ সিনেমার চিত্রনাট্য।
এবং এর গান ‘আম্মাজান, আম্মাজান- চোখের মণি আম্মাজান’ হয়ে গেল মায়েদের জন্য সন্তানের পক্ষ থেকে এক সুরেলা অর্ঘ্য।