তাকে কত কিছু দিয়েই পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। সঙ্গীত শিল্পী, দলছুট ব্যান্ডের প্রাণ, কবি বা লেখক। সব পরিচয় পেছনে পড়ে যায় তার নামের কাছে। তিনি তারুণ্যের আরেক নাম, তিনি এক আবেগের নাম- তার নাম সঞ্জীব চৌধুরী।
সিলেটের হবিগঞ্জের ছেলে সঞ্জীব চৌধুরী চলে গেছেন তার ১৭ বছর। ২০০৭ সালের উনিশ নভেম্বর। সিডর নামক এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক হামলার ঠিক তিন দিন পর। প্রকৃতি আগেই যেন হাহাকার করেছে সঞ্জীবের তিরোধানের।
কারণ তার গাওয়া গান ‘দুই হাতে আগুন তারও’ হলেও, সঞ্জীবের শব্দে ছিল আগুন। এই শব্দ কেবল গানের নয়। সঞ্জীব চৌধুরীকে বলা হয় আধুনিক ফিচার সাংবাদিকতার অনুপ্রেরক। একটি প্রজন্ম এই সাংবাদিকের পথ অনুসরণ করে ফিচার সাংবাদিকতায় আলো এনেছেন। খবর শুধু খবর নয়, খবর হতে পারে তথ্য বহুল একটি গল্পও – তা প্রমাণ করে গেছেন সঞ্জীব চৌধুরী। নিটোল তথ্য ও উপাত্তকে ব্যাকারণের বাইরে গিয়ে কাব্যিকভাবে উপস্থিত করার শাব্দিক মুন্সিয়ানা তার মত বোধ করি খুব কেউ দেখাতে পারেনি। তরুণবেলাতে তার এই শব্দের যাদুতেই মোহিত হয়ে থাকতো তার চারপাশ।
একেবারে তখন থেকে যখন মেধা তালিকায় স্থান পেয়ে তিনি ভর্তি হন ঢাকা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে। লেখাপড়ায় অসাধারণ সঞ্জীব চৌধুরী এ তার পরিবারের সবাই জানেন। পরিবার মানে বন্ধু সহ বিশাল এ বৃত্ত। যাদের সাথে হৈ হৈ করে কেটে গেছে সঞ্জীবের বেচে থাকার সময়গুলো। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক—দুটি পরীক্ষাতেই মেধাতালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। এমনকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু না জীবনের হিসাব পছন্দ ছিল তার- না ছিল পড়ালেখায় জানা সমাধান। তাই সব বাদ দিয়ে বিভাগ পরিবর্তন করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ালেখা করেন। আর এভাবেই একজন সম্ভাব্য গণিতবিদ বনে গেলেন বাংলাদেশের ফিচার মহীরুহ। কর্মজীবনে সাংবাদিকতাকেই বেছে নিয়েছিলেন।
জীবন যাপনে সঞ্জীব চৌধুরীর মত বোহেমিয়ান কজন ছিলেন তা হাতের আঙুলে গুনে শেষ করা যাবে। কখনো গানে কখনো আড্ডা কখনো সুর ও সুরার তালে তার জীবন কেটে গেছে। তার এই লাগামহীন জীবন যাপনের কারণেই অকাল প্রয়াণ বলে মানেন তার বন্ধুরা।
দাম্পত্য জীবনেও বিদ্রোহী ছিলেন তিনি। ব্যক্তিজীবনে যেমন প্রতিবাদী ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ঠিক তেমনই। ছাত্র জীবন থেকেই তার ভেতরের আগুন ছিল অদম্য। ১৯৭৯-৮০ সালে তিনি ঢাকা কলেজের বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিল ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনে শহীদ সোমেন চন্দ, খান মুহাম্মদ ফারাবি, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও শহীদ কমরেড তাজুল ইসলাম। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯০ সময়ে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন নিজের লেখাপড়া, ছাত্র পড়ানোর মাঝেই। নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থান এখন প্রায় বিস্মৃত হতে চলেছে বটে, কিন্তু যারা এর সাক্ষ্মী তারা আজও রাজু ভাস্কর্যে দাঁড়িয়ে ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে আঙ্গুল তুলে চিৎকার করা সঞ্জীবকে মনে রেখেছেন। সাম্যবাদের স্বপ্ন নিয়ে ফাঁসির রজ্জু আলিঙ্গন করা কর্নেল তাহেরের খুনির নাম যিনি জানতে চাওয়া বিপ্লবীকে বাঁচিয়ে রেখেছেন স্মৃতিতে। সঞ্জীব চৌধুরী তাদেরই একজন যিনি পুলিশ কর্তৃক ধর্ষিত ও নিহত কিশোরী ইয়াসমিন আক্তারের জন্য গান বানিয়ে রক্তে আগুনের ফুলকি বুনেছেন। এই হেয় করায় বা অপমান করায় রাজপথে ফুঁসে উঠার জোয়ার- একটা সময় সেই জোয়ারের স্রোত ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। নব্বইয়ের স্বৈরতন্ত্রকে আসনচ্যুত করতে তার শাব্দিক অস্ত্র ভুলে যাওয়ার অবকাশ নেই।
আধুনিক ফিচার সাংবাদিকতার পাশাপাশি গানেরও আধুনিকতার অধ্যায় শুরু করেন এই শিল্পী। সিঙ্গার- সং রাইটার হিসেবে তার প্রভাব ছিল অভূতপূর্ব। নিজের লেখা কবিতায় সুর বসিয়ে কিযে করে ফেলতেন – সেটা তিনি নিজেও জানেন না। টেবিল চাপড়িয়ে গান করার থেকে গিটার সুর তোলার এই ভ্রমণটা ছিল অনেকটাই সুরের ঘোড়ায় চড়ে তালের টেপাস্তর পার করা রাজপুত্রের মতন।
১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করা সঞ্জীবের কণ্ঠের দাপট ছিল কানে বাজতে থাকা বজ্রের মতন। প্রচলিত সিলেটি টান ছিল না তার কণ্ঠে। বরং ছিল দরাজ কণ্ঠের আবেগ। কখনো তা ‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায়’ গিয়ে থেমেছে, কখনো ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ’ বলে প্রেমে মজেছে। আবার কখনো ‘কেউ জানে না না জানে আড়াল’ গেয়ে অভিমানও করেছে।
তার বোহেমিয়ান জীবনে বোধ করি অভিমানের স্থান ছিল সবচেয়ে বেশি। তার সহকর্মীরা তাকে সামলে গেছেন। আবার বিপদে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজরা ঠিকই ভালোবেসে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছেন। সেই বাড়িতে তার প্রিয়তমা স্ত্রী শিল্পী বাস করতেন। সাথে একমাত্র কন্যা কিংবদন্তী। এই বিয়েটাও তার প্রতিবাদ। সমাজের আরোপিত নিয়মের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় জাল ছিড়ে। নিজের ধর্মের বিপরীতে গিয়ে- অনেকটাই নিজস্ব বলয় ভেঙে ও ভুলে তিনি সংসার শুরু করেন। তার স্ত্রী খন্দকার আলেমা নাসরীন শিল্পী নিজেও সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন একটা সময়। এখন অনেকটা অভিমানেই তিনি আছেন অন্তরালে। সবশেষ তাকে দেখা যায় অপর এক গীতিকবি রাসেল ও’নীলের প্রয়াণের দিনে।
সঞ্জীব চৌধুরীর জীবনটাই ছিল এমন। খানিকটা যাযাবর – খানিকটা প্রভাবকের। তার সান্নিধ্যে আসা কেউ তাকে ভোলার ক্ষমতা এখনও অর্জন করতে পারেননি। একারণেই বলা হয় তার ’শীষ্য’রা তারই মতন বোহেমিয়ান ঘরানা। যারা রোজ বাড়ি ফিরলেও মনে মনে গাইতে থাকেন,
যাই পেরিয়ে সকাল দুপুর রাত
যাই পেরিয়ে নিজের ছায়া বাড়িয়ে দেয়া হাত।
রাত জাগা পথ তাকে ছুঁয়েছে কি এমন
ছোঁয়া যায় তবে পথ নিরবধি
আসলেই তিনি আর বাড়ি ফেরেননি। ২০০৭ সালে বাইলেটারেল সেরিব্রাল স্কিমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হন সঞ্জীব চৌধুরী। একই বছরের ১৫ নভেম্বর অসুস্থ হয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাকে। চার দিন পর তিনি চলে যান। ১৯ নভেম্বর। হয়তো ‘ফিরে পেতে চাই’ গেয়ে এমন একটা কিছু চাইছিলেন- যা পৃথিবী তাকে দিতে পারেনি। দিতে পেরেছে অপার তেপান্তর।