চিরবিদায় নিলেন সমসাময়িক ভারতীয় মঞ্চনাটকের অন্যতম পথিকৃৎ, ‘থিয়েটার অব রুটস’ আন্দোলনের অগ্রদূত রতন থিয়াম। ২২ জুলাই মঙ্গলবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে মণিপুরের ইম্ফলের আঞ্চলিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
রতন থিয়াম ছিলেন মণিপুরের ঐতিহ্যবাহী শিল্পরূপ ও পারফরম্যান্স ধারাগুলোকে আধুনিক নাট্যভাষার সঙ্গে মিশিয়ে নির্মাণ করেছিলেন এক ব্যতিক্রমী নাট্যশৈলী। তার থিয়েটারে স্থান পায় লোকসংস্কৃতি, আধ্যাত্মবাদ, দার্শনিক গভীরতা এবং প্রথাভাঙা দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি ‘কোরাস রেপার্টরি থিয়েটার’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান ছিলেন। পাশাপাশি ছিলেন ভারতের জাতীয় নাট্যবিদ্যালয় (ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা, এনএসডি)-এর চেয়ারম্যান।
২০১৫ সালে শুভাশিস সিনহার নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রতন থিয়াম বলেছিলেন, ‘সভ্যতা, সংস্কৃতি বলতে আমরা কী বুঝি? কোট-প্যান্ট পরা, মুঠোফোন হাতে ঘোরা? একেবারেই নয়। এসব তো আর্টিফিশিয়াল জিনিস, নকল। সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে এসবের সম্পর্ক নেই। বরং এসবের মধ্যে থেকে আমরা সত্যিকারের সভ্যতা থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। শিকড়ে ফেরার জন্যই আদিবাসী সংস্কৃতিকে জানা দরকার।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘নাটক করতে গেলে স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। স্যাক্রিফাইস…প্রথমেই জানতে হবে যে মঞ্চনাটকে কোনো স্টার ইমেজ নেই। যে যতই ভালো পারফরম্যান্স করুক না কেন, কোনো স্টার ইমেজ নেই, পপুলারিটি নেই, টাকাপয়সা আসবে না। অর্থাৎ এখানে কোনো ইন্ডাস্ট্রি নেই। নাটক হচ্ছে এমন একটা জিনিস, যেখানে সৌন্দর্যবোধ বা নান্দনিকতার খোঁজে অনেক কলা বা ক্র্যাফটকে জড়ো করা হয়।’
এই বিশ্বাস থেকেই ১৯৭৬ সালে তিনি গড়ে তোলেন ‘কোরাস রেপার্টরি থিয়েটার’। এই দলের মঞ্চে উঠে এসেছে মণিপুরের নিজস্ব সংগীত, নৃত্য, মার্শাল আর্ট, লোককাহিনি ও পৌরাণিক বয়ান। তার কাজকে বলা হয় ‘সাইকো-ফিজিক্যাল থিয়েটার’, যেখানে শরীর ও চেতনার গভীর সংযোগ ঘটে। তার নাটকে বারবার উঠে এসেছে যুদ্ধ, যন্ত্রণা, বিচ্ছিন্নতা।
রতন থিয়ামের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘চক্রব্যুহ’, ‘ঋতুসংহার’, ‘উত্তর প্রিয়দর্শী’, ‘আশিবাগি ইশেই’, ‘ইম্ফল ইম্ফল’, ‘কারানাভারাম’ (মহাভারতের কর্ণকে নিয়ে), ‘দ্য কিং অব ডার্ক চেম্বার’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজা’ অবলম্বনে) এবং বহুল আলোচিত ‘ম্যাকবেথ’। তার ব্যাখ্যায়, ‘ম্যাকবেথ’ ছিল একধরনের মানসিক ব্যাধির নাট্যরূপ, যেখানে আছে ক্ষমতার মোহ, পাপবোধ ও আত্মধ্বংসের ঘূর্ণি।
রতন থিয়ামের মৃত্যুতে ভারত ও বাংলাদেশের নাট্যজগতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। রতন থিয়ামের কর্ম, দর্শন ও বিশ্বাস ভারতীয় থিয়েটারে নতুন ভাষা ও প্রস্তাব এনেছে, যা শুধু ভারত নয়, গোটা প্রাচ্য নাট্যদর্শনকে দিয়েছে গভীর দিশা। তাঁর মৃত্যুতে থিয়েটার হারাল এক দিকপাল ব্যক্তিত্বকে, যিনি মাটি, মানুষ ও মননের গভীর যোগসূত্রে নির্মাণ করেছিলেন এক প্রান্তিক শিল্পভাষা। এমনটাই বলছেন অনুরাগী, ভক্তরা।
আসাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা তাকে ‘থিয়েটার অব রুটস’ আন্দোলনের অগ্রনায়ক উল্লেখ করে বলেন, ‘তিনি ছিলেন এমন একজন দূত, যিনি মণিপুর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছেন। তার শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে।‘ মণিপুরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং এক টুইটে লেখেন, ‘রতন থিয়াম ছিলেন ভারতীয় থিয়েটারের এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা এবং মণিপুরের গর্বিত সন্তান। তার শিল্পনিষ্ঠা, দূরদৃষ্টি এবং মণিপুরি সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা শুধু থিয়েটারজগৎকেই সমৃদ্ধ করেনি, আমাদের পরিচিতি ও অস্তিত্বকেও করেছে সমৃদ্ধ। তার কাজ ছিল মণিপুরের আত্মার প্রতিধ্বনি—যেখানে ছিল আমাদের গল্প, সংগ্রাম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ। তার আত্মা শান্তিতে বিশ্রাম করুক। রেখে যাওয়া সৃষ্টির মাধ্যমে এবং যাদের অনুপ্রাণিত করেছেন, তাদের মধ্য দিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন তিনি।’
নাটকের পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন সংবেদনশীল কবিও। মণিপুরি ভাষায় লেখা তার দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘তালাপামেল নাহাকসু’ ও ‘সনাগী থম্বাল’ থেকে নির্বাচিত ২০৫টি কবিতা বাংলায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘নির্বাচিত কবিতা’ নামে। এসব কবিতায় উঠে এসেছে যুদ্ধ, সহিংসতা, আদিবাসী জীবনের টানাপোড়েন ও অস্তিত্ববাদী প্রশ্ন।
রতন থিয়াম ২০ জানুয়ারী ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা জোশী এবং মালতী রাও ২০০৩ সালে “সাম রুটস গ্রো আপওয়ার্ডস” নামের এক তথ্যচিত্রে রতন থিয়ামের জীবন ও কর্ম, তার রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং রাজনৈতিক প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে থিয়েটারকে ব্যবহার করার পন্থাকে তুলে ধরেন।