Chitralee will take you closer to the world of entertainment.
Chitralee will take you closer to the world of entertainment.
রবিবার, জুন ১, ২০২৫

জাফর পানাহি: ক্যামেরার কাছে কারাগারের পরাজয়   

‘জেল থেকে মুক্তি পাবার পরও যখনই আমি জেলখানার পাশ দিয়ে যেতাম, ভাবতাম, দেয়ালের ওপারে যারা আমার সঙ্গে ছিল, তারা এখন কেমন আছে, কি করছে?’

“পানাহিকে যা করতে বলা হয় তা সে করে না; আসলে তার সফল ক্যারিয়ার গড়েই উঠেছে তাকে যা করতে বলা হয়েছে তা না করার মধ্য দিয়ে।”

কথাটা বলেছেন ইরান অধ্যয়ন এবং তুলনামূলক সাহিত্যের ইরানি-আমেরিকান অধ্যাপক হামিদ দাবাশি। যার জন্মও ইরানে। এই কথাটা তিনি বলেছেন জাফর পানাহির পুরো জীবন ব্যাখ্যা করে। কারণ জাফর পানাহি ইরানের জনগণের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, জুলুম, নারীর প্রতি অবমাননা ও ঊনমানুষ দৃষ্টিভঙ্গি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্বকরন,সমাজের দারিদ্র্য ও সামাজিক অসাম্যের চিত্র তুলে ধরেছেন তার চলচ্চিত্রে। আর এই সমস্তই কাল হয়ে দাঁড়ালো পানাহির জন্য। নানা সময়ে শিকার হলেন রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের।

পানাহি তার ক্যারিয়ারের শুরুতে ইরানের আরেক বিখ্যাত নির্মাতা আব্বাস কিয়ারোস্তামীর সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার নিজেরও ছিলো বেশ কিছু শর্টফিল্ম। কালক্রমে নির্মাতা বনে যান পানাহি নিজেই। তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র “দ্য হোয়াইট ব্যালুন” প্রকাশ পায় ১৯৯৫ সালে আর ওই বছরই জিতে নেয় কান চলচ্চিত্র উৎসবের “ক্যামেরা ডি’অর” পুরস্কার।  

পর্যায়ক্রমে তার চলচ্চিত্রেরা জিততে থাকে আন্তর্জাতিক পুরস্কার। লোকার্নো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘দ্য মিরর’ (১৯৯৭) এর জন্য গোল্ডেন লেপার্ড, ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে দ্য সার্কেল (২০০০) এর জন্য গোল্ডেন লায়ন এবং অফসাইড (২০০৬) সিনেমার জন্য বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে জিতেন সিলভার বিয়ার।

এই সমস্ত সিনেমার মাধ্যমে ইরানী শাসকদের আসল চেহারা তুলে ধরেছেন জাফর পানাহী যার ফলে রাষ্ট্রীয় রোষানলে পড়েন এই নির্মাতা। তার দ্য মিরর সিনেমার বিষয়বস্তু ছিলো নারীর প্রতি রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, স্টেডিয়ামে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধের প্রতিবাদে করেন সিনেমা অফসাইড।

‘ট্যাক্সি’ সিনেমার একটি দৃশ্যে জাফর পানাহি

পানাহি দিন দিন হয়ে উঠেছিলেন ইরানি বুদ্ধিবৃত্তির এক অন্যতম বাতিঘর। সমাজ-সংস্কৃতি বিনির্মান ও নিপীড়িত মানুষদের ভয়েস হয়ে উঠেছিলেন যা কিনা প্রশ্নবিদ্ধ করে তুললো ইরান সরকারের মনোভাব ও শাসনকে।    

২০০৯ সালের ইরানি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ব্যাপক বিতর্কিত হওয়ার পর, পানাহি প্রকাশ্যে সবুজ আন্দোলনের (গ্রিন মুভমেন্ট) সাথে যুক্ত হন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জালিয়াতির প্রতিবাদ করেন এবং সংস্কারের দাবি তোলেন। সবুজ বিপ্লবে নিহত এক ছাত্রের শেষকৃত্যে যোগদানও করেছিলেন। তার এই রাজনৈতিক অবস্থান তাকে সরাসরি শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূল করে তোলে। তার উপর প্রথম আরোপ করা হয় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ২০১০ সালে পানাহিকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাদণ্ড দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনী ইরানী শাসকগোষ্ঠি। তাকে কোন প্রকার চলচ্চিত্র নির্মাণ, বিদেশ ভ্রমণ এবং সাক্ষাৎকার দেওয়া থেকে ২০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। গ্রেপ্তারের পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০১০ এর ২৫শে মে পানাহিকে ২ লাখ ডলারের বিনিময় শর্তে জামিনে মুক্তি দেয় ইরান সরকার। তবে জারী থাকে নিষেধাজ্ঞা।

কিন্তু তা সত্ত্বেও দমে যাননি পানাহি কারণ লেখকের কলম, চিত্রশিল্পীর তুলি কিংবা নির্মাতার ক্যামেরা শাসকের ভয়ে কখনোই তটস্থ থাকেনা। এ এমনই এক বোধ যার শেষ কেবলমাত্র শারীরিক মৃত্যুতে। তাইতো ইরানী সরকার থামিয়ে রাখতে পারেনী এই নির্মাতাকেও। গোপনে ঠিকই নির্মাণ করে গেছেন সিনেমা।

২০০৬ এ বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে জাফর পানাহি

নিষেধাজ্ঞার ভিতরেও জাফর পানাহি ২০১১ সালে বানিয়েছেন “দিস ইজ নট আ ফিল্ম” তথ্যচিত্র। তথ্যচিত্রটিকে একটি ফ্ল্যাশ ড্রাইভে নিয়ে সেটিকে আবার একটি কেকের ভেতরে লুকিয়ে রেখে ইরান থেকে গোপনে পাঠানো হয়েছিলো ২০১১ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনের জন্য। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৬৩তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পানাহি এবং কাম্বুজিয়া পার্তোভির সিনেমা “ক্লোজড কার্টেন (২০১৩)” প্রদর্শিত হয়; সেরা চিত্রনাট্যের জন্য সিলভার বিয়ার জিতে নেয় পানাহি। তার আরেক চলচ্চিত্র ট্যাক্সি (২০১৫) একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৬৫তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব প্রতিযোগিতায় প্রিমিয়ার হয় এবং জিতে নেয় উৎসবের সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার গোল্ডেন বিয়ার। এছাড়াও  ২০১৮ সালে তৈরি করেন “৩ ফেসেস”  ২০২২ সালে নো বিয়ার্স (২০২২)।

২০২২ সালের জুলাই মাসে আবারও গ্রেপ্তার হন পানাহি। পানাহির গ্রেপ্তারের কিছুদিন আগেই একটি বিল্ডিং ধসে বহু প্রাণহানী হওয়াতে সরকারের সমালোচনা করায় আটক হন ইরানী চলচ্চিত্র মোস্তফা আল আহমাদ এবং মোহাম্মদ রসুলফ। যিনি এখন জার্মানিতে নির্বাসিত। পানাহি তার সহকর্মী চলচ্চিত্র পরিচালক মোহাম্মদ রসুলফের আদালতের শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন। প্রসিকিউটরের অফিসে যাওয়ার পর পানাহিকে গ্রেপ্তার করে কুখ্যাত এভিন কারাগারে পাঠায় ইরান সরকার। পরের বছরের ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে পানাহি অনশন ধর্মঘট করেন এবং দুই দিন পর জামিনে মুক্তি পান।

২০২৩ সালে এভিন কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর জাফর পানাহি (বামে) ও তার স্ত্রী তাহেরেহ সাঈদী। ছবি: রয়টার্স

পানাহি তার জীবনের ১৬টি বছর ছিলেন ইরান নামক কারাগারে। সয়েছেন অমানবিক যন্ত্রণা।  কিন্তু কোন কারাগারই দমাতে পারেনী এই নির্মাতাকে। বরং ইরান সরকারের এই অমানবিক অন্যায়কেই পানাহি করে তোলেন তার সিনেমার উপজীব্য। নিপীড়িত মানুষের হয়ে লড়েছেন, বাকহীন মানুষের কথা হয়ে উঠেছেন, দারিদ্যপীড়িত মানুষের চিৎকার ছিলেন পানাহি নিজেই, হয়ে উঠেছিলেন অত্যাচারিত নারীদের কন্ঠ। অবশেষে হয়েছেন কয়েদীদের বন্ধুও। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ভুলে যাননি তার সাথে জেলে থাকা আরো কিছু মানুষের কথা। তাইতো নির্মাতা বলেন,

জেল থেকে মুক্তি পাবার পরও যখনই আমি জেলখানার পাশ দিয়ে যেতাম, ভাবতাম, দেয়ালের ওপারে যারা আমার সঙ্গে ছিল, তারা এখন কেমন আছে, কি করছে?

তিনি যোগ করেন “এই লোকেরা আমার লোক হয়ে গিয়েছিল। আমি ভাবলাম, ‘আমি কীভাবে তাদের পিছনে ফেলে যেতে পারি?’

পানাহি তাদের ছেড়ে যাননি। তার জেলবন্ধুদের অন্ধকার জীবন, নিজের ও তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়, অত্যাচার, জুলুমের গল্পের অনুপ্রেরণায় বানিয়ে ফেললেন ৭৮তম কান উৎসব জয়ী সিনেমা “ইট ওয়াজ় জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট”।

রাজনৈতিক থ্রিলার এই সিনেমাটি পাঁচ জন প্রাক্তন কয়েদির গল্প নিয়ে। জেলে থাকাকালীন তাদেরকে যে ব্যক্তি নির্যাতন করেছে, মুক্ত হওয়ার পরে সেই বন্দিরা একদিন তাকে চিনতে পারে। গল্পটি অপ্রত্যাশিত মোড় নেয় যখন তারা নির্যাতনকারী লোকটির মুখোমুখি হয়। ন্যায়বিচার, প্রতিশোধ এবং ট্রমার জটিলতা সংক্রান্ত এই ছবিটি দিয়েই পানাহি জিতে নেন কানের ‘পাম ডি’অর।

বরাবরের মতোই সরকারি অনুমতি ছাড়াই শ্যুট করেছিলেন তিনি। পানাহি ভ্যারাইটির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাকে সম্পূর্ণ গোপনে কাজ করতে হয়েছিল যেখানে কেবল আমার খুব ঘনিষ্ঠ দলই চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু এবং চিত্রনাট্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত ছিল। শুধুমাত্র আমার DP, সাউন্ড ডিজাইনার এবং আমার অভিনেতারা জানত। একমাত্র তারাই সত্যিকার অর্থে জানত যে আমরা কী নিয়ে কাজ করতে যাচ্ছি, এবং এইভাবেই আমাদের পুরো পথ এগিয়ে যেতে হয়েছিল।

‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ সিনেমায় মাহসা আমিনির প্রতিবাদ, নারীর স্বাধীনতায় মাহসার জীবন উৎসর্গ করাকেও ভুলে যাননি নির্মাতা। এই প্রথম পানাহি তার কোন সিনেমায় হিজাব ছাড়া ইরানী নারীদের পর্দায় এনেছেন; যা ছিলো মাহসা আমিনিসহ সেই সকল নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা যারা নিজেদের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে ইরান সরকারের নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন ও অত্যাচারিত হয়েছেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে স্বাভাবিক দুনিয়ায় এসে একটা বদলে যাওয়া ইরান সমাজের উপস্থিতি টের পান পানাহি। কারণ তিনি জেলে থাকতেই নারী স্বাধীনতা আন্দোলনে মারা যান মাহসা আমিনী আর রাস্তায় নেমে পড়েন হাজার হাজার নারীরা, খুলে ফেলেন পরাধীনতার স্মারক হিজাব। এই নারী জাগরণ নিয়ে নির্মাতা বলেন,

‘‘আমি শহরে ঢুকলাম, হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম যে তেহরান বদলে গেছে, কারণ কিছু মহিলাকে দেখলাম হিজাব ছাড়াই রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। বেশিরভাগ মহিলারাই তাদের হিজাব খুলে ফেলেছিলেন। এই বিষয়টা নিয়ে এতো নিপীড়ন, দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও চার দশক পরে আমরা তাদেরকে পর্দা ছাড়াই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দেখতে পাচ্ছিলাম। এবং এটি ছিল সম্পূর্ণ নতুন কিছু।“

‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ সিনেমার পোস্টার

আর এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করেননি পানাহি। সিনেমায় তুলে এনেছেন হিজাববিহীন নারীদের রূপ। একটি ঘটে যাওয়া নারী বিপ্লবের ঘটনাকে তিনি কিভাবেই বা এড়িয়ে চলবেন? কারণ এই নারী আর তাদের স্বাধীনতাওতো ছিলো পানাহির দীর্ঘ জীবনের সংগ্রামের অন্যতম মহান অংশ।

সর্বশেষ ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা সিনেমার তকমা ‘পাম ডি’অর’ জিতে পানাহি আবারো প্রমাণ করলেন সত্যের বয়ান আর সাহসী ক্যামেরার কাছে জালীমের বুলেট কিংবা কারাগার তুচ্ছই যতই তা শক্তিশালী মনে হোক না কেন। এবং কানে পুরস্কার পাওয়ার পর পানাহি আবারো তার ইরানী ভাতৃদ্বয়কে স্বাধীনতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি শুধু একটিই কথা বলতে চাই। সারা পৃথিবীতে যত ইরানি মানুষ রয়েছেন, যাদের মধ্যে হয়তো মতের পার্থক্যও রয়েছে, তাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ: আপনাদের নিজের মধ্যে যে সমস্যাগুলি আছে, সেগুলিকে পাশে রেখে দেশের স্বাধীনতার কথা ভাবুন।’

Share this article
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Read next

টিভি শোতে হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী গুলতেকিন ও ছেলে নুহাশ  

কবিতা, অনুবাদ, উপন্যাস ও চিত্রনাট্য রচনার জন্য সুপরিচিত গুলতেকিন খান। ২০১৬ সালে কাব্যগ্রন্থ ‘আজো, কেউ হাঁটে…
0
Share