সম্প্রতি ঘোষণা দেয়া হয়েছে ভারতের ৭১তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সেখানে বাজিমাত করেছে সামাজিক ব্যঙ্গাত্মক চলচ্চিত্র ‘কাঁঠাল: আ জ্যাকফ্রুট মিস্ট্রি’। সিনেমাটি জিতেছে সেরা হিন্দি ফিচার ফিল্মের স্বীকৃতি। এতে অভিনয় করেছেন সানিয়া মালহোত্রা, অনন্ত যোশী, বিজয় রাজ, রাজপাল যাদব, রঘুবীর যাদব, নেহা শ্রফ, গুরুপাল সিং প্রমুখ। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন যশবর্ধন মিশ্র এবং চিত্রনাট্য লিখেছেন অশোক মিশ্র।
২০২৩-এর ১৯ মে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে মুক্তিপায় ‘কাঁঠাল – অ্যা জ্যাকফ্রুট মিস্ট্রি’ সিনেমাটি। ভারতে ওটিটির কোন সিনেমা সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হলে সেটি জাতীয় চলচ্চিত্রের জন্য জমা দেয়া যায়। ‘কাঁঠাল’ ওটিটিতে মুক্তি পেলেও সেন্সর সার্টিফিকেট থাকায় জাতীয় চলচ্চিত্রের জন্য জমা দেয়া সম্ভব হয়েছে।
মোবা নামের একটি ছোট শহরের এমএলএ মুন্নালাল প্যটেলের (বিজয় রাজ অভিনীত) বাগান থেকে ‘আংকেল হং’ নামের বিশেষ প্রজাতির দুটি কাঁঠাল চুরিকে কেন্দ্র করে আগাতে থাকে এক ঘণ্টা পঞ্চান্ন মিনিটের এই সিনেমা।
হাইপ্রোফাইল এই কেসের (!) তদন্তভার দেওয়া হয় স্থানীয় থানার মহিলা ইন্সপেক্টর মহিমা বাসর (সানিয়া মালহোত্রা)-কে। শুরু হয় অভিযান। সন্দেহ ঘনীভূত হয় মুন্নালাল প্যটেলের বাড়ির সদ্য বরখাস্ত মালির উপর। ঘটনাচক্রে জানা যায়, এই মালির মেয়ে অমিয়া (অপূর্বা চতুর্বেদী) ইতিমধ্যে নিখোঁজ। অথচ পনেরো কেজির দুটি কাঁঠাল খোঁজার তদন্তে ব্যতিব্যস্ত পুলিশ ও প্রশাসন সে সম্পর্কে উদাসীন। উল্টে প্রশাসনের উপর চাপ কমাতে প্রেস কনফারেন্স করে মেয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ায় পুলিশের সাহায্য চাইতে আসা মালির উপরেই পুরো ঘটনার দায় দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। গরীব অসহায় মানুষের উপর সমাজ-রাজনীতির বিশেষ করে উচ্চশ্রেণির আধিপত্যকামী মানসিকতার চমৎকার প্রতিফলন দেখিয়েছেন পরিচালক।
বলিউডে গত কয়েক বছরের মধ্যে ২০২৩ সাল ছিল সবচেয়ে তারকাময়, চমকপ্রদ ও বক্স অফিস কাঁপানোর বছর। শাহরুখ খানের ‘পাঠান’ ও ‘জওয়ান’, রণবীর কাপুরের ‘অ্যানিমেল’, সানি দেওলের ‘গদার ২ ’, সালমানের ‘টাইগার ৩’, রণবীর-আলিয়ার ‘রকি অউর রানি কি প্রেম কাহানি’, শ্রদ্ধা-রণবীরের ‘তু ঝুটি ম্যায় মাক্কার’, অক্ষয় কুমারের ‘ওহ! মাই গড ২’ ছিল বছরের বড় বাজেট ও তারকাবহুল সিনেমা। এছাড়াও কারিনা কাপুর, বিজয় ভার্মা ও জয়দীপ অহলাওয়াতের ‘জানে জা’, মনোজ বাজপেয়ির ‘সির্ফ এক বান্দা কাফি হ্যায়’, শর্মিলা ঠাকুর ও মনোজ বাজপেয়ির ‘গুলমোহর’- এর মতো সিনেমাও ছিল আলোচনায় ও দর্শকপ্রিয়। কিন্তু এসব সিনেমাকে পাস কাটিয়ে সেরার তালিকায় উঠে আসে অখ্যাত কাঁঠালের সিনেমা।
নামকরা সব সিনেমা ২০২৩ সালে মুক্তি পেলেও ‘কাঁঠাল: আ জ্যাকফ্রুট মিস্ট্রি’ সেরা হিন্দি ফিচার ফিল্মের পুরস্কার জিতেছে গল্পে তার সমাজবাস্তবতা ও প্রকৃত দুনিয়াকে তুলে আনার কারণে। কাঁঠাল উদ্ধারকে কেন্দ্র করে চিত্রনাট্যকার ভারতের কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য, জাতিভেদ, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, ক্ষমতাবানের মনোপলি, ক্ষমতার স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাধারণ মানুষের মধ্যকার আকাশ-পাতাল পার্থক্যকে তীব্র ব্যঙ্গাত্মক মনোভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। ছবিটি পুরোপুরি ব্ল্যাক কমেডি বলা না গেলেও নিঃসন্দেহে এটি একটি স্যাটায়ারধর্মী বাস্তবমুখী কমেডি সিনেমা। যার কারণেই এটি জিতে নেয় সেরা হিন্দি ফিচার ফিল্মের পুরস্কার।
কাঁঠাল দিয়ে হাস্যরস করে বাস্তবকে তুলে এনে সেরার পুরস্কার জিতে নেয়াটা চার্লি চ্যাপলিনের সেই বিখ্যাত কথাটিকেই আবার প্রমাণ করেছে। চ্যাপলিন বলেছিলেন “মেকিং ফান ইজ সিরিয়াস বিজনেস”। অনেকেই বলছেন নির্মাতা যশোবর্ধন চ্যাপলিনের পদ্ধতি ও বঙ্কিমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের লেখাকে এক সূত্রে গেঁথেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র তার ‘মনুষ্য ফল’ নামক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “আমাদের দেশের এক্ষণকার বড়মানুষদিগের মনুষ্যজাতিমধ্যে কাঁটাল বলিয়া বোধ হয়। কতকগুলি খাসা খাজা কাঁটাল, কতকগুলি বড় আটা, কতকগুলি কেবল ভুতুড়িসার, গরুর খাদ্য। কতকগুলি ইঁচোড়ে পাকে, কতকগুলি কেবল ইঁচোড়েই থাকে, কখন পাকে না।…
তবে নির্মাতা কখনোই এই প্রবন্ধ পড়েছেন কিনা কিংবা বাংলা ভাষাও পড়তে পারেন কিনা তা নিশ্চিত নয় একেবারেই। তবু বলা যায়, কি আশ্চর্য মিল ভাবনায় !