রাজপথ থেকে সামাজিক মাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম থেকে মিডিয়ার অলিগলি- সবখানে শুধুই এখন প্রতিবাদের ঝড়। বিষয়- এমন একজন তরুণী যিনি হয়তো বিনোদনের কেউ নয়, কিন্তু তার কারণেই বাংলাদেশ থেকে কলকাতার ইথার সংযোগের মিডিয়ার মুখ আরেকবার একত্র হয়েছে প্রতিবাদের ভাষায়।
আবারও বলা, কারণ ২০২৪ সালের জুলাই মাসটি ছিল বাংলাদেশের জন্য ইতিহাসের নতুন অধ্যায়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন পরিণত হয় সরকার পরিবর্তনের সোপানে। সেই সুবাদে আগস্টের ৫ তারিখের পর থেকে বাংলাদেশ দেখছে নতুন সকাল। আন্দোলনের শুরুতেই কলকাতার তারকা দেব শান্তি চেয়ে পোস্ট করেন। কবির সুমন গান বেঁধেছেন।
দেব ও কবির সুমন ছাড়াও আরও অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। যদিও কয়েকটি মিডিয়াতে গুজব ছড়ানোর অভিযোগও পাওয়া গেছে, গেছে প্রমাণ। সেসব ছাপিয়ে পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার সাথে সম্পর্ক পুনরায় শক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে। বিশেষ করে ছাত্ররা ঝাপিয়ে পড়েন প্রতিবাদের প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায়।
একইভাবে পুলিশকে কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের জনতা আরেকবার। ড. রাধা গোবিন্দ করের প্রতিষ্ঠিত আরজি কর মেডিকেল কলেজে ঘটে যাওয়া নৃশংস হত্যাকাণ্ডে এবার পথে নেমেছেন জনতা- ছাত্র ও মিডিয়ার কিছু পরিচিত মুখ।
৯ আগস্ট ট্রেইনি চিকিৎসককে হত্যা করা হয়, যার খোলাশা ঘটতেই ১৫ তারিখ থেকে ফেটে পড়েছেন নানাজনে।
১৪ তারিখ রাতে – অর্থ্যাৎ ১৫ তারিখ, ভারতের স্বাধীনতা দিবসের একেবারে সূচনালগ্নে রাত দখলের ঘোষণা দেয় সেখানকার মেয়েরা। আর তাতেই যোগ দেন সকলে।
মিডিয়াজুড়ে ছড়িয়ে যায় সাদা কুর্তা পরা শুভশ্রীর ছবি। সেই মিছিলে ছিলেন বাংলাদেশের প্রিয়তমা ইধিকা পলও।
ছিলেন সরকারের ‘প্রিয়’ হিসেবে খ্যাত পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। সাথে ছিলেন তার স্ত্রী পিয়া চট্টোপাধ্যায়। আবীর চট্টোপাধাায় সুরে সুর মিলিয়েছেন। এমনকী তার নতুন সিনেমা ‘বাবলী’র স্পেশাল স্ক্রিনিং ও প্রিমিয়ারও তারা বাতিল করেছেন। এই সিনেমাতে তার সাথে আছেন শুভশ্রী। মিছিলে আরও দেখা গেছে তুফানকন্যা মিমি চক্রবর্তীকেও।
সপ্তাহ ধরে চলতে থাকা এই বিক্ষোভে অনেকের অনেক মন্তব্যে আবার ফেটে পড়েন সহকর্মীরাই। শ্রীলেখা মিত্র ক্রিকেট তারকা সৌরভ গাঙ্গুলীর উদ্দেশ্যে সরাসরি তার অসন্তুষ্টি জানান। কারণ সৌরভ তার বক্তব্যে এই পাশবিক হত্যাকে ‘ইনসিডেন্ট’ বলেছিলেন।
পরিচালক ও তার বন্ধুরা মাকে নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেন।
অনেকেই ভেবেছিলেন রাজনৈতিক চাপে হয়তো কলকাতার তারকারা বিক্ষোভ থেকে দূরে থাকবেন। কৌশিক সেন, ঋদ্ধি সেন, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, পার্নো মিত্র, অরিন্দম শীল-সহ অনেককেই দেখা গিয়েছিল রাতের শহরে। বাংলাদেশে যেমন শুধু শিক্ষার্থী নয়- এক হয়েছিল ছাত্র জনতা। তেমনই কলকাতার রাস্তায় শুধু নারী নয়, তালে তাল মিলিয়ে হেঁটেছেন পুরুষরাও। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অরিজিৎ সিংও।
অরিজিৎ সিং সবার আগেই একটি স্টেজ শোতে ঘটনার উল্লেখ করে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন উপস্থিত সকলকে নিয়ে। এতে তার প্রতি জনতার ভালোবাসা আরও বাড়ে। কারণ অবস্থাদৃষ্টে সরকারের বিপক্ষে গিয়েই তারকাদের নিজস্ব অবস্থান প্রকাশ করতে হচ্ছে।
পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার বন্ধন থেকে পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ার উপর অভিমান ভুলে বিক্ষোভে সুর মেলায় বাংলাদেশের তারকারাও।
আজমেরী হক বাঁধন ১৬ আগস্ট জমায়েতের ডাক দিয়ে লেখেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী বাংলাদেশে পূর্বের প্রতিটি ধর্ষণ মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে এবং কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে চলমান প্রতিবাদের সংহতিতে “মেয়েরা রাত দখল করো”। ১৬ আগস্ট শুক্রবার রাত ১০টা, জমায়েত রাত ৯টা থেকে। সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।’ একই পোস্ট শেয়ার করেছেন অভিনেত্রী সুনেরাহ বিনতে কামাল, নাজিফা তুষিসহ অনেকে।
নিজের প্রোফাইলে অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী একটি পোস্ট শেয়ার করেন। সেখানে দেখা যায় একটি প্ল্যাকার্ড, লেখা, ‘আপনি যদি আপনার মেয়েকে “খারাপ” স্পর্শ সম্পর্কে শিক্ষিত করেন, তবে নিশ্চিত করুন যে আপনার ছেলেও এটি সম্পর্কে জানে।’
ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হওয়া চিকিৎসকের ছবি শেয়ার করে অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এমন মৃত্যু যেন আর কোথাও কারও না হয়!’
প্রতিবাদী কণ্ঠ ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান একটি গান বাঁধেন, যা ১৩ আগস্ট নিজের ফেসবুকে প্রকাশ করেন। গানটি এরই মধ্যে চার লাখেরও বেশি মানুষ শুনেছেন। গানটি শেয়ার করার পর থেকেই প্রশংসা পাচ্ছে সায়ান। হয়ে গেছে ভাইরাল।
বলিউডও বসে নেই। অভিনেতা আয়ুষ্মান খুরানা একটি কবিতা পোস্ট করেন সোশাল মিডিয়াতে। যেখানে নারী হয়ে জন্মানোর অনিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্নভাবে নিজের অনুভুতি ব্যক্ত করেন। বিগবস বিজয়ী মুনওয়ারও একইভাবে কবিতা পোস্ট করেন। বলিউডের অভিনেত্রীরাও কথা বলেন এ প্রসঙ্গে।
অভিনেত্রী কারিনা কাপুর খান লেখেন, ‘১২ বছর পরেও একই ঘটনা। একই প্রতিবাদ। কিন্তু আমরা এখনও পরিবর্তনের অপেক্ষা করে চলেছি।’
প্রীতি জিনতার অভিযোগ আরও মানবিক। তিনি লিখেছেন, ‘খারাপ লাগে যখন দেখি, গ্রেফতারের পরে একজন ধর্ষকের মুখ ঢাকা থাকে। কিন্তু নির্যাতিতার ছবি ও নাম সব প্রকাশ্যে আনা হয়।’
তারকা টুইঙ্কেল খান্না বলেন, ‘আমি আমার মেয়েকে ঠিক সেগুলোই শেখাচ্ছি, যেগুলি আমিও ছোটবেলায় শিখেছি। একা পার্কে যেও না, স্কুলে যেও না, সমুদ্রেও না। একা কোনও পুরুষের সঙ্গে কোথাও যেও না। বিশেষ করে রাতে তো একদমই নয়। কখন যাবে, এটার চেয়েও বড় বিষয় হল একা যদি তুমি কোথাও যাও, ফিরে নাও আসতে পারো।’
শ্রীলেখা মিত্র যেভাবে ন্যায়ের জন্য কথা না বলায় সৌরভ গাঙ্গুলিকে প্রশ্ন করেছেন, সেভাবেই প্রশ্ন করতে হয়, আসলেই কী ন্যায় অন্যায় নিয়ে কথা বলা জরুরি তাদের, যাদের কোটি কোটি মানুষ সীমানার এপার ওপারে অনুসরণ করেন?
একারণেই কলকাতার শিল্পীরা ঠিকই তাদের সহকর্মীদের প্রশ্ন করছেন, প্রশ্ন শুরু করার দ্বায়িত্ব এখন চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেরও। কারণ এটি কোন একটি মৃত্যু বা হাজারো প্রাণের উপর নির্বিচারে গুলি ছোড়ার ঘটনা নয় শুধু- এই প্রশ্ন মানবিকতা বনাম পাশবিকতার।
পশ্চিমবঙ্গে শিল্পীরা আবারও এক হচ্ছেন। ১৮ আগস্ট টেকনিশান স্টুডিয়োতে জমায়েত করে আরজি কর হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন টলিপাড়ার তারকারা। সেদিন বিকালে টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে একে একে টলিউড তারকারা আসতে শুরু করেন। রাজ-শুভশ্রী, পরমব্রত, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, সোহিনী সরকার, ইশা সাহা, সৌরসেনী, ইমন চক্রবর্তী, পাওলি দাম, ঋত্ত্বিক চক্রবর্তী, অপরাজিতা চক্রবর্তী, কৌশিক-ঋদ্ধি সেনসহ অনেকেই। ওদিকে শ্যামবাজার থেকে আরজি কর হাসপাতাল পর্যন্ত ১৪৪ ধারা তথা ভারতীয় ন্যায়-সংহিতার ১৬৩ ধারা ধারা জারি থাকায় তারা শান্তিপূর্ণ অবস্থানে আন্দোলন চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেন।
পাহাড় বা সমতলে, পদ্মা বা গঙ্গার ধারে- এভাবেই সকলে এক দাবীর নীচে। সেই দাবী ন্যায্যতার। ন্যায়ের পক্ষের। ন্যায়ের পথের।
লেখা: সৈয়দা ফারজানা জামান রুম্পা