প্রথমেই বলে রাখা ভালো, কনসার্টটির আয়োজন করেছেন ট্রিপল টাইম কমিউনিকেশন। বিভিন্ন সময়ে সামাজিক মাধ্যম বা গণমাধ্যমেও দেখা যায় অনেকে শিল্পীর নাম ধরে কনসার্টের আয়োজন নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা করেন। মূলত শিল্পী ও দর্শকের মাঝে যিনি সেতুবন্ধনের কাজ করেন তিনি আয়োজক। তার ভূমিকা সবচাইতে বেশি। এবার ফিরে দেখা যাক আতিফ আসলামের ২৯ নভেম্বরের কনসার্টের দিকে।
ম্যাজিকাল নাইট ২.০ শিরোনামে আতিফ আসলামের কনসার্টের টিকিটে লেখা ছিল গেট বন্ধ হয়ে যাবে সন্ধা ছয়টা নাগাদ। সরেজমিনে দেখা গেছে সাড়ে ছয়টার সময়েও টিকেট কেটে অপেক্ষারত দর্শকের লাইন বনানী কবরস্থান পর্যন্ত চলে গেছে। যা পরবর্তীকালে কাকলী বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত চলে যায়। অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া সাড়ে সাতটার পর কনসার্টে প্রবেশ করতে পারেননি বলে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে মূলত অতিরিক্ত টিকেট বিক্রি এবং প্রবেশ পথে উশৃঙ্খল জনতার উপস্থিতিকে দায়ী করেন সেখানকার নিরাপত্তার স্বার্থে নিযোজিত কর্মীরা। চিত্রালীকে নাম না প্রকাশ করার স্বার্থে প্রবেশপথে উপস্থিত একজন নিরাপত্তা কর্মী জানান, আয়োজকরা লাগামহীন টিকিট বিক্রি করেছেন। পাশাপাশি গেট ভেঙে ডুকে পড়ার একদল যুবক আছে। সবাইকে সামাল দিয়ে দর্শক প্রবেশ করাতে কষ্ট হচ্ছে। দেরীও হচ্ছে।
চিত্রালী সরেজমিনে দুইবার প্রবেশদ্বার ভেঙে ফেলার ঘটনার সাক্ষী হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, বিকাল থেকে সেনাবাহিনী বাধ্য হয়ে লাঠি চার্জ করে দফায় দফায়। তবে তাতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে কোন সাধারণ দর্শক বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। সেনাবাহিনী দাবী করে, প্রকৃত দর্শক যেন কনসার্ট উপভোগ করতে পারে এজন্য তাদের অনেকটা উপায়হীন হয়েই লাঠি চার্জ করে। পরে সাড়ে সাতটা নাগাদ প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তিনটি জোনে কনসার্টের টিকেট বিক্রি করা হয়েছিল। যার মাঝে ম্যাজিকাল জোনের টিকেটের মূল্য ছিল ১০ হাজার টাকা। আয়োজকরা ঘোষণা দেয়, এখান থেকে গায়ককে সামনাসামনি দেখা যাবে। তবে দর্শকদের অনেকের অবিযোগ আয়োজকদের ভলেন্টিায়ারের কারণে তারা ঠিক মত কনসার্ট সামনে থেকেও উপভোগ করতে পারেনি। ফ্রন্ট জোন ও জেনারেল বাকী এই দু্ই ক্যাটাগরিতে বিক্রি করা হয় কনসার্টের টিকিট। আর্মি স্টেডিয়ামের কিছুটা অংশ বেরিকেড দিয়ে জোন আলাদা করে ফেলা হয়। তবে এর আগের কয়েকটি কনসার্টের মতন এই কনসার্টে এই বেরিকেড নাজুক ছিল না।
আয়োজনের শেষ অবধি ফ্রন্ট জোনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে উপস্থিত নিরাপত্তা বাহিনী। অতিরিক্ত টিকিট বিক্রির অভিযোগ দর্শকও করেছেন। উপস্থিত একজন দর্শক জনিয়েছেন, এ ধরণের কনসার্টে বেশি মূল্য দিয়ে টিকেট কাটি যেন আরামে গান উপভোগ করতে পারি। আশা করি এরপর থেকে আয়োজকরা বিষয়টি মাথায় রাখবেন। তবে মাঠের ভেতরে উপস্থিত দর্শকরা নির্বিঘ্নে কনসার্ট উপভোগ করেছেন। প্রবেশের পর থেকে আর কোনও দুরাবস্থার সৃষ্টি হয়নি। অনেককেই নেচে গেয়ে সকলের পারফরম্যান্স উপভোগ করতে দেখা গেছে।
২৯ নভেম্বরের ম্যাজিকাল নাইটে আতিফ আসলাম মূল আকর্ষণ হলেও তাহসানের তিরিশ মিনিটের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স অনেকের মন ভরিয়ে দিয়েছে। ‘বিন্দু আমি’, ‘আলো আলো’ গেয়ে স্টেডিয়ামে দর্শকের হাতে হাতে তারা জ্বালিয়ে দেন যেন তিনি। শিল্পীর অনুরোধে সকলের মোবাইলের ফ্লাশলাইট জ্বলে উঠে। আর তাতেই মাঠে জমে তারার মেলা। কিছু দিন আগে তার কণ্ঠের যে সমস্যার কথা ছড়িয়ে পড়েছিল লোকমুখে সেদিন তার লাইভ পারফরম্যান্স সব সংশয় দূর করে দেয়। ক্যারিশম্যাটিক পারফরম্যান্সে ‘প্রেম তুমি’ গানের মতই নতুন প্রেম হলেন যেন তিনি।
এদিন আরও পারফর্ম করেছেন বাংলাদেশি ব্যান্ড কাকতাল। এবং পাকিস্তানি তরুণ শিল্পী হান্নান। বিকেল পাচটায় কাকতাল ব্যান্ডের গান দিয়ে শুরু হয় মূল কনসার্ট। ব্যান্ডটি ‘গোলকধাঁধা’, ‘আবার দেখা হবে’, ‘সোডিয়াম’, ‘ওপেন সিক্রেট’সহ একাধিক গান করে। এরপর মঞ্চে আসেন পাকিস্তানের তরুণ সংগীতশিল্পী আবদুল হান্নান। তিনি এতো দর্শকের সামনে গান করেননি আগে বলেই ধন্যবাদ জানালেন উপস্থিত সকলকে। যাবার আগে বলে গেলেন- আই লাভ ইউ বাংলাদেশ।
আতিফ আসলামকে নিয়ে নেটিজেনরা মজা করে বলছেন, আসলাম- গাইলাম- নাচালাম ও গেলাম। মাঠভর্তি দর্শকের সামনে যেভাবে আতিফ আসলাম পারফর্ম করেছেন তা একাধারে দর্শকদের জন্য উচিতান্নের পর মিষ্টান্নসম। অর্থ্যাৎ বিশেষ অভিজ্ঞতার সামিল। তার একের পর এক গানে উন্মাদনার সৃষ্টি হয়। মাঠের পরিবেশ ভালো থাকায় দর্শকরা উপভোগ করেছেন যা সরেজমিনে চিত্রালী অনুধাবন করেছে। গোলাবি আঁখে থেকে ও লামলে, দমাদম মাস্ত কালান্দার থেকে কুন ফায়া কুন- সব গান একের পর এক গেয়ে তিনি সবাইকে তিন ঘণ্টা মাতিয়ে রাখেন। মাঝে মাঝে তিনি কথাও বলেছেন। বলেন, বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় বাসস্থান।
এরপর এক জনের নিয়ে আসা ছবি উপহার হতে নিয়ে বলেন, আপনি আজকের দিনটিকে আমার জন্য বিশেষ করে দিলেন। দিয়েছেন জ্যাকেট উপহার। এমন কী রাত ১১টায় পারফরম্যান্স শেষ করে ফেলার পরেও দর্শকের অনুরোধে ফিরে এসে আরও চল্লিশ মিনিট গান করেন পাকিস্তানের এই শিল্পী, যিনি গোটা উপমহাদেশেই জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও খুব অল্প সময়ে দুইবার এসে পারফরম করলেন এই গায়ক।
শেষের আগে মাঠে নিরাপত্তার স্বার্থে নিয়োজিত কর্মীদের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। নিরাপত্তার পাশাপাশি তারা অনেকেই গান উপভোগ করেছেন। কেউ কেউ সহকর্মীর সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে তাহসানের গানে কণ্ঠ মিলিয়েছেন। কেউ আবার দূর থেকে আতিফ আসলামকে পেছনে রেখে সেলফি তুলেছেন। সব মিলিয়ে সঙ্গীতের প্রতি তাদের নিজেদের ভালোবাসার কারণেই এবার মাঠে বিশৃঙ্খলা হয়নি বলে জানিয়েছেন জেনারেল ক্যাটাগরিতে থাকা কয়েকজন দর্শক।
প্রথমেই আয়োজকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এই কারণে যে, বেলা শেষে কনসার্টের ভালো বা খারাপ শিল্পীর নামের সাথে জড়িয়ে যায়। অনেকেই বলেছেন আতিফ আসলামের জন্য ঢাক শহরে ট্রাফিক, বা অমুক শিল্পীর কনসার্টে মারামারি। পুরো দায়ের অনেকটাই আয়োজকের। শুধু টিকেট বিক্রি বা ভেন্যু নির্ধারণ ও শিল্পী নির্বাচনই আয়োজকের মূল কাজ নয় বলে জানান উত্তরা নিবাসী সুজেয় রায়। তিনি মনে করেন, প্রতিটি দর্শক আয়োজকের অতিথির মত। ফলে সকলের জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকা জরুরি। তা না হলে অচীরেই আয়োজকেদের দায়সারা আয়োজনের কারণে শিল্পীরা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন বলেও জানান অনেক দর্শক।
সব কথার শেষ কথা, কনসার্ট মানেই দর্শকের সাথে শিল্পীর মনের ও ভাবের আদান প্রদান। যা অন্য মাধ্যমে শিল্পীর গান দেখে উপভোগ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের কনসার্ট কালচার আয়োজকদের সুবিবেচনায় সমুন্নত থাকবে- এটাই একমাত্র চাওয়া সঙ্গীতপ্রেমীদের।