বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে যে কয়জন অভিনেতা তাদের হৃদয়গ্রাহী অভিনয় দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন দেশের রুপালী পর্দা তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ‘মিয়াভাই’ খ্যাত জনপ্রিয় অভিনেতা আকবর হোসেন পাঠান ফারুক। আজ ১৫ মে এই কিংবদন্তী অভিনেতার মৃত্যুদিন। ২০২৩ সালের এই দিনে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে দীর্ঘ চিকিৎসার পর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ চলে যান তিনি।
এই বিনয়ী অভিনেতা তার অভিনয় দিয়ে কাঁদিয়েছেন দর্শকদের, কখনো হাসিয়েছেন। কখনো ছিলেন প্রতিবাদী, কখনো নিঃশব্দ প্রেমিক, কখনো সাদামাটা এক কৃষক। দর্শকদের হৃদয়ের গভীরে মিশে যাওয়ার এক চমৎকার জাদু তিনি জানতেন।
১৯৭১ সালে এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ দিয়ে চলচ্চিত্রে পা রাখেন ফারুক। তবে খ্যাতির চূড়ায় আরোহন করেন খান আতাউর রহমানের ‘সুজন সখী’ (১৯৭৫) সিনেমার মাধ্যমে। সুজন চরিত্রে দরদভরা ও দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে চিরদিনের জন্য মানুষের মনের ঘরে জায়গা করে নেন তিনি।
রুপালী পর্দার মিষ্টি মেয়ে কবরীর সঙ্গে তার জুটি সিনেমা পেরিয়ে হয়ে উঠেছিলো আরো বেশীকিছু। এরপর আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ তে নয়ন চরিত্রে তার হৃদয়বিদারক অভিনয় পৌঁছে দেয় তাকে আরেক উচ্চতায়। ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বউ’ -এ কদম সারেং হয়ে তিনি আর অভিনেতাই থাকেননি, হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশি সিনেমার ইতিহাসের রূপালী পালক।
চলচ্চিত্র সমালোচকদের মতে, ফারুক—এই নাম কেবল একটি শিল্পীর নাম নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে সময়ের ইতিহাস। তাঁর প্রকৃত নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে, ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে তিনি হয়ে যান পুলিশের ‘ওয়ান্টেড’। সেই সময় চলচ্চিত্রে নাম লেখাতে গিয়ে পুরোনো নামটি রেখে কাজ করাটা নিরাপদ ছিল না। তখনকার সহকর্মী ও বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে তার নতুন নাম হয় ‘ফারুক’। ২০১৬ সালে বিবিসি বাংলায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ছয় দফা আন্দোলনের পর আমি ওয়ান্টেড ছিলাম, যে কারণে নাম দিয়ে দিল ফারুক। ওরা বলল, এই নামে তোমাকে প্রথমে কেউ ধরবে না। দ্বিতীয়ত, চলচ্চিত্রের নামগুলো ছোট হলে ভালো হয়, যেমন রাজ্জাক, উজ্জ্বল, শাবানা। এরপর এই নামই হয়ে ওঠে তার স্থায়ী পরিচয়।
তবে যে নামটা সবচেয়ে বেশি মানুষের মনে প্রোথিত হয়ে গেছে, তা হলো ‘মিয়াভাই’। চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় নির্মিত ‘মিয়াভাই’ সিনেমা তাকে এনে দেয় অমরত্ব। তিনি হয়ে ওঠেন সেই ভাই, যিনি প্রতিবাদ করেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, পরিবারকে আগলে রাখেন, গ্রামীণ জীবন ও সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠেন।
তার অভিনীত অসংখ্য সিনেমার মধ্যে ‘লাঠিয়াল’, ‘আবির্ভাব’, ‘লাল কাজল’, ‘নয়নমণি’ ‘সুজন সখী’ ‘সারেং বউ’ সিনেমাগুলো কালজয়ী হিসেবে গ্রন্থিত থাকবে দেশের সিনেমা ইতিহাসে।
ফারুককে নিয়ে চলচ্চিত্র শিক্ষক মতিন রহমান বলেছিলেন, ‘ফারুক চরিত্রকে নিজের করে নিতেন। গ্রামের সাধারণ মানুষের জেদ, তাড়না, ভালোবাসা—সব তিনি তুলে আনতে পারতেন অভিনয়ে’।
১৯৭৫ সালে ‘লাঠিয়াল’ ছবিতে শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। তিনি ২০০৬ সালে বাচসাস পুরস্কারে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার এবং ২০১৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেন।
১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার এক গ্রামে জন্ম নেওয়া ফারুক বেড়ে ওঠেন পুরান ঢাকায়। চিত্রনায়ক ফারুক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও। আজ নানা পর্যায়ের শিল্পী ও তার অনুরাগী, সহশিল্পীরা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছেন এই কিংবদন্তীকে।