ভারতের ৭০ দশকের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রী সিমি গারেওয়াল। ১৯৪০ সালের ১৭ অক্টোবর ভারতের পাঞ্জাবের এক গারেওয়াল জাট-শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ‘দ্য লেডি ইন হোয়াইট’। তাঁর বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার। ভারতে জন্মগ্রহণ করলেও মূলত সিমি বেড়ে ওঠেন ইংল্যান্ডে এবং এই কারণে ইংরেজিতে তাঁর সময়ের অন্যান্য ভারতীয়দের তুলনায় তিনি বেশ এগিয়ে ছিলেন। যা তাঁর ভাগ্যের দুয়ারও খুলে দেয়। টারজান সিনেমা দিয়ে সিমির চলচ্চিত্র যাত্রা শুরু। বর্তমান জীবনে একা হলেও অনেক পুরুষই এসেছিলো সিমির জীবনে যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শিল্পপতি রতন টাটা ও সাইফ আলী খানের বাবা ক্রিকেটার মনসুর আলী খান পতৌদি।
সিনেমায় যাত্রা ও অতঃপর
দীর্ঘদিন ইংল্যান্ডে থাকার কারণে ছোট থেকেই ইংরেজিতে পারঙ্গম ছিলেন সিমি। যে কারণেই ১৯৬২ সালে ‘টারজান’ সিরিজের সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব পান সিমি। সিমির বয়স তখন মাত্র ১৫।
১৯৬২ সালেই মুক্তি পায় টারজান সিরিজের ‘টারজান গোস টু ইন্ডিয়া’ সিনেমা। টারজান খ্যাত নায়ক জক মাহোনিরও এটি ছিল টারজানের চরিত্রে অভিনয় করা প্রথম ছবি। এই সিনেমায় আরো ছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা ফিরোজ খান। আর প্রথম সুযোগেই অভিনয় দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে দেন সিমি। এরপর ঠিক করে ফেলেন নিজ লক্ষ্য অভিনেত্রী হওয়া। ক্রমেই হয়ে উঠেন ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা। একে একে করে ফেলেন অনবদ্য সব সিনেমা।
১৯৬৬ সালে রাজ খোসলার পরিচালনায় করেন সিনেমা “দো বদন”, ১৯৬৮ সালে করেন “সাথী”, রাজ কাপুরের সাথে ১৯৭০ সালে করেন বিখ্যাত সিনেমা “মেরা নাম জোকার” যা তার ক্যারিয়ারে আরেকটি রূপালী পালক যুক্ত করে। এরপর ১৯৭২ সালে অভিনয় করেন সাহিত্যে নোবেলজয়ী লেখক হারমেন হেসের লেখা উপন্যাস ‘সিদ্ধার্থ’ থেকে বানানো কলম্বিয়া পিকচার্সের একই নামের সিনেমায়। এই সিনেমায় গারেওয়াল একটি নগ্ন দৃশ্যেও অভিনয় করেছিলেন যা ভারতে বেশ বিতর্কেরও সৃষ্টি করেছিল। এরপর ১৯৮০ সালে করেন “কার্জ” এবং পাঞ্জাবি চলচ্চিত্র উদীকান।
এছাড়াও যশ চোপড়ার ‘কাভি কাভি’ এবং ‘চলতে চলতে’ সিনেমাসহ আরো বেশ কিছু জনপ্রিয় ও ঐতিহাসিক সিনেমায় অভিনয় করে নিজের স্টারডমের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটান এই নায়িকা। আর হয়ে উঠেন বিখ্যাত ও সামাজিক সাফল্যে ভরা ভারতীয় উপমহাদেশের পুরুষদের শাশ্বত কামনার সোনালী আপেল।
বাংলা সিনেমা
এই নায়িকা এমনকি বাংলা সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। অস্কারজয়ী কিংবদন্তী নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে অভিনয় করেছেন সিমি। অভিনয় করেছেন নির্মাতা মৃণাল সেনের আরেক কালজয়ী সিনেমা ‘পদাতিক’-এ।
সিমি গারওয়ালের পুরুষেরা
সিমি গারেওয়াল ১৭ বছর বয়সে প্রথম প্রেমে পড়েন। তার প্রেমিক ছিল জামনগরের মহারাজা শত্রুশল্যাসিংহজি। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সময়ে জামনগরের এই মহারাজা ছিলেন সিমির প্রতিবেশী। প্রতিবেশী হওয়া সূত্রেই তাদের মধ্যে প্রেমের সুত্রপাত হয় যা প্রায় তিন বছর ধরে চলেছিল। ফিল্মফেয়ারের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে, সিমি জানিয়েছিলেন যে তার এই সম্পর্ক তাকে চিরতরে (জেলাসী) ঈর্ষা থেকে মুক্তি দিয়েছে।
রতন টাটা
১৯৭০-এর দশকে রতন টাটা এবং সিমি গারেওয়ালের প্রথম দেখা হয়েছিল, যখন দুজনেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিলেন। তরুণ শিল্পপতি টাটা এবং গ্ল্যামারাস অভিনেত্রী গারেওয়াল নিজেদের মধ্যে এক পারস্পরিক সংযোগ খুঁজে পেয়েছিলেন। তাদের প্রেম বেশ গভীর ছিল কিন্তু তা বিয়ে পর্যন্ত গড়াতে ব্যর্থ হয়। তাদের প্রেম ভেঙে গেলেও সিমি ভুলেন নি তার দেখা সেরা পুরুষটাকে। তাইতো সিমি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “রতন এবং আমি বহু বছর ধরে একে অপরকে চিনি। তিনি একজন আদর্শ ব্যক্তি – রসিক ও বুদ্ধিদীপ্ত , নম্র এবং একজন ভদ্রলোকের প্রতীক। অর্থ তার কাছে কখনই অগ্রাধিকার পায়নি। ভারতে থাকার চেয়ে বিদেশে থাকাকালীন তিনি অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।”
রতন টাটা এই বিচ্ছেদ সহ আরো চার বার বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না তার এবং মৃত্যু আগ পর্যন্ত অবিবাহিতই থেকে গেছেন এই শিল্পপতি।
মনসুর আলী খান পতৌদি
সাইফ আলী খানের বাবা মনসুর আলী খান পতৌদির সাথেও সম্পর্ক ছিল সিমির। তারা একে অপরের প্রেমে পাগল ছিল। পতৌদির ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে আসতেন সিমি, আবার সিমির আউটডোর শ্যুটিংয়ে জেতেন তার প্রেমিক মনসুর। এমনকি বড় বড় অনুষ্ঠানে দেখা যেত দুজনে হাতে হাত ধরে হাঁটছেন। কিন্তু নিয়তি তাদের নিয়ে যায় অন্য কোথাও। বিচ্ছেদ হয়ে যায় দুজনের। মনসুর আলী খান পতৌদি বিয়ে করেন আরেক কাল্ট ফিগার অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরকে। আর সিমি বিয়ে করেন দিল্লির অভিজাত চুন্নামাল পরিবারের সদস্য রবি মোহনকে। কিন্তু সিমির এই বিয়ে শেষপর্যন্ত টেকেনি। ১৯৭৯ সালে সিমি এবং রবি আলাদা হয়ে যান।
এরপর থেকে আর বিয়েই করেননি ‘র্যদেভূ উইথ সিমি গারেওয়াল” টক শো হোস্ট ও ভারতের এই কাল্ট-ক্ল্যাসিক অভিনেত্রী।