সিনেমা শুধু গল্প বলার মাধ্যম নয়, কখনো কখনো এটি ব্যক্তিগত অনুভূতি, স্মৃতি, এবং জীবনযাত্রার এক অন্তর্নিহিত প্রতিফলন হয়ে ওঠে। পরিচালক সোফিয়া কপোলা ও স্পাইক জোনজের জীবন থেকে উঠে আসা দুটি চলচ্চিত্র Lost in Translation (২০০৩) ও Her (২০১৩) নিঃসঙ্গতা, সম্পর্কের জটিলতা, এবং বিচ্ছেদের পর অনুভূত শূন্যতাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে, যা আজও দর্শকদের হৃদয়ে গভীরভাবে নাড়া দেয়। অনেকে মনে করেন, এই দুটি সিনেমা আসলে তাদের ব্যর্থ বৈবাহিক সম্পর্কের দুটি আলাদা দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। যদিও তারা কখনোই সরাসরি স্বীকার করেননি, কিন্তু সিনেমাগুলোর আবেগ ও উপস্থাপনায় সেই ছাপ স্পষ্ট।
সোফিয়া কপোলা ও স্পাইক জোনজ ৯০-এর দশকে সৃজনশীল দুনিয়ার অন্যতম প্রতিভাবান দুই ব্যক্তি ছিলেন। কপোলা ছিলেন একাধারে লেখক ও পরিচালক, আর জোনজ ছিলেন একজন পরীক্ষামূলক ও নতুন ধারার গল্পকার, যিনি তার সংগীত ভিডিও এবং সিনেমার জন্য পরিচিত। তারা ১৯৯৯ সালে বিয়ে করেন, কিন্তু মাত্র চার বছর পর, ২০০৩ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।
তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভাঙনের কারণ সম্পর্কে তারা কখনো প্রকাশ্যে কথা বলেননি। তবে ধারণা করা হয়, ক্যারিয়ারের চাপ, আবেগগত দূরত্ব এবং একে অপরের প্রতি কমে যাওয়া সংযোগই ছিল বিচ্ছেদের মূল কারণ। বিচ্ছেদের পর, তারা দুজনই দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যা সম্পর্কের ভাঙন ও নিঃসঙ্গতার গল্প বলে।
বিচ্ছেদের পরপরই, কপোলা নির্মাণ করেন Lost in Translation, যা নিঁখাদ একাকীত্বের গল্প বলে। সিনেমার মূল চরিত্র শার্লট (স্কারলেট জোহানসন) তার স্বামীর সঙ্গে টোকিওতে এসেছে, কিন্তু সেখানে গিয়ে বুঝতে পারে, তার স্বামী তাকে আর আগের মতো বোঝে না। শার্লটের স্বামী একজন ব্যস্ত ও আত্মমগ্ন ফটোগ্রাফার (জিওভান্নি রিবিসি), যে সবসময় নিজের কাজে ব্যস্ত এবং স্ত্রীর প্রতি উদাসীন।
অনেকের মতে, এই ফটোগ্রাফার চরিত্রটি স্পাইক জোনজের ছায়া। ছবিতে শার্লট অনুভব করে যে, তার স্বামী তার আবেগগত চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, এবং সে নিঃসঙ্গতায় ডুবে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে সে বিল মারে অভিনীত মধ্যবয়স্ক অভিনেতা বব হ্যারিসের সঙ্গে এক গভীর বন্ধন গড়ে তোলে। যদিও এটা কোনো রোমান্টিক সম্পর্ক নয়, তবে দুজনের বোঝাপড়া ও নিঃসঙ্গতার অনুভূতিগুলো সিনেমার আবেগকে গভীর করে তোলে।
কপোলা কখনো সরাসরি বলেননি যে এই সিনেমাটি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত, তবে এটি তার জীবনেরই প্রতিফলন বলে অনেকেই মনে করেন।
প্রায় এক দশক পর, ২০১৩ সালে, স্পাইক জোনজ Her নির্মাণ করেন, যা একাকীত্ব ও বিচ্ছেদের আরেকটি রূপক চিত্র তুলে ধরে। সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র থিওডোর (জোয়াকিন ফিনিক্স) একজন একাকী লেখক, যে তার বিবাহবিচ্ছেদের কষ্ট নিয়ে লড়াই করছে। বাস্তব জীবনের সম্পর্ক থেকে বাঁচতে সে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এক অপারেটিং সিস্টেম (ভয়েস: স্কারলেট জোহানসন)-এর প্রেমে পড়ে।
থিওডোরের সাবেক স্ত্রী ক্যাথরিন (রুনি মারা) সিনেমায় তাকে স্পষ্টভাবে বলে দেয় যে, সে সম্পর্কের বাস্তব জটিলতাগুলো মেনে নিতে পারে না এবং সবকিছু সহজ ও নিখুঁত করে তুলতে চায়। এই সংলাপ অনেকটাই Lost in Translation-এ শার্লটের অনুভূতির বিপরীত প্রতিক্রিয়া, যেন জোনজ তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কপোলার চিন্তাগুলোর উত্তর দিচ্ছেন।
দুটি চলচ্চিত্রই মূলত সম্পর্কের ক্ষয়, নিঃসঙ্গতা ও বোঝার অভাবকে তুলে ধরে, তবে একেবারে বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে। কপোলার দৃষ্টিতে সম্পর্কের প্রধান সমস্যা ছিল একে অপরকে অনুভব করতে না পারা, আর জোনজের দৃষ্টিতে এটি ছিল হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার জন্য শোক করা।
এটি একধরনের সিনেম্যাটিক সংলাপের মতো, যেখানে দুইজন আলাদা সময়ে, আলাদা ভাষায়, নিজেদের গল্প বলছে। একদিকে কপোলা তার চরিত্র শার্লটের মাধ্যমে বলছেন, ‘আমি অনুভব করি, আমি অবহেলিত,’ আর অন্যদিকে, জোনজ তার চরিত্র থিওডোরের মাধ্যমে উত্তর দিচ্ছেন, ‘আমি হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু আমি বোঝার চেষ্টা করছি।’
যদিও তারা কখনোই সরাসরি স্বীকার করেননি যে এই সিনেমাগুলো তাদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলন, তবে যেকোনো সংবেদনশীল দর্শক সেই সংযোগ সহজেই অনুভব করতে পারে।
সিনেমা সবসময়ই পরিচালকের আত্মিক প্রকাশের একটি মাধ্যম। সোফিয়া কপোলা ও স্পাইক জোনজ নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও বিচ্ছেদের গল্প বলার জন্য একে অপরকে জবাব দেননি, বরং তারা নিজেদের যন্ত্রণাকে শিল্পে রূপান্তর করেছেন।