Chitralee will take you closer to the world of entertainment.
Chitralee will take you closer to the world of entertainment.
মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩, ২০২৪

রুদ্রর থেকে যাওয়া ‘না থাকা জুড়ে’

কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ | ছবি: গুগল

কবিতায় ছিল তার ক্ষুরধার শক্তি। তার এক একটি শব্দ যেমন বুলেট, তেমনই পাথরে এঁকে দেওয়া নকশার মতন। কিন্তু তার গল্পটা ছোট গল্পের মতই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। তাই তার চলে যাবার পরেও তার গল্প তথা জীবন নিয়ে আজও শেষ নেই আগ্রহের। হাহাকারের। বা শব্দের উল্লাসের। এই ছোট গল্পের নায়কের নাম রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো ৬৮ বছর। তবে বালাই ষাট আর তার করতে হয়নি। তার আগেই চলে গেছেন শত অনিয়ম আর অবহেলা করে নিজের সাথে। পেছনে রেখে গেছেন পঙক্তিমালা। এই বোহেমিয়ানের জীবনটা অনুদযাপিতই থাকতো যদিনা তার কবিতা গান হতো।

একটা সময় বাংলাদেশের টিভি নাটকে গান ব্যবহার করা হতো। নাটকের জন্যেই গান নির্মাণ করা হতো বলা যায়। সেই গানগুলো জনপ্রিয়তাও পেয়েছে সেকালে। ‘সাজানো হলো না কিছু জীবন তাসের ঘর’ বা ‘কাশফুলের মালা পরাবো তোমার অঙ্গে’ এই গানগুলো সেই আমলের কালজয়ী সৃষ্টি। এর মাঝেই একটি নাটকে শোনা গেল একটি গান, ‘আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে, আছো তুমি হৃদয়জুড়ে..’ মাত্র একটি গান, একটি হাহাকার, আর সাথে সাথে লাখো প্রেমিক মনে ঠাঁই করে নেন রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। কারণ এটি তারই কবিতা থেকে নেওয়া কিছু অংশ, তারই আনমনে সুর করা গান হয়ে যায়, যা নাটকে ব্যবহার করা হয়। ১৯৯২ সালে গানটি প্রচারের পর দারুণ জনপ্রিয়তা পায়, তবে কবির নিঃসঙ্গ প্রস্থানের পর। রুদ্র পৃথিবী ত্যাগ করেন ১৯৯১ সালে।

রুদ্রর একটি গানের দল ছিল। নাম ‘অন্তর বাঁজাও’। আশির দশকের শেষ দিকে গানের দল নিয়ে গানটি গেয়েছেন অনেক জায়গায়। রুদ্রর চলে যাবার পরও গানের দলটি বিভিন্ন আয়োজনে এই গানটি করতো। ১৯৯১ সালের ১৬ই অক্টোবরে রুদ্রের কিছু কাছের বন্ধু ও অনুরাগী মিলে আর্ট কলেজে রুদ্র স্মরণে অনুষ্ঠান আয়োজন করলেন। ঐ অনুষ্ঠানে বিপ্লব চক্রবর্তী গাইলেন ‘ভালো আছি, ভালো থেকো’। তরুণদের মুখে মুখে ফেরা শুরু করে এই গান। ৯০ এর দশকে যখন বাংলাদেশে ব্যান্ড গানের একরকম জোয়ার শুরু হয়। অনেক ব্যান্ডের মত তীর্থক আর সিম্ফনি ছিল তরুণদের দুটি দল।  

১৯৮৮ সনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গান পাগল কয়েকজনের সম্মিলিত চেষ্টায় গঠিত হয় প্রথম সম্পুর্ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ভিত্তিক মিউজিক্যাল ব্যান্ড ‘অর্ক’। পরবর্তীতে আশিকুজ্জামান টুলু আর্ক নামে ব্যান্ড গঠন করলে অর্ক নাম পরিবর্তন করে ‘তীর্থক’ নামে যাত্রা শুরু করে ব্যান্ডটি। আবু মহসিন ছিলেন এই ব্যান্ডের সদস্য।

১৯৯২ সালে তীর্থকের অ্যালবাম ‘দুই দুয়ারী’তেই গানটি প্রথম মুক্তি পায়। ওদিকে, সিম্ফনি ব্যান্ডের পক্ষ থেকে গানটি পারফর্ম করা হয় ১৯৯২ সালের বিটিভির ঈদের অনুষ্ঠানে। মনি জামান তখন গানটি পরিবেশন করেন। তীর্থকের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা করা হয়, ‘গান চুরি’র। তাদের দাবী, তীর্থকের স্বত্ব বিক্রি করা গান ছিল এটি যা অডিও আর্ট থেকে মনি জামান গানটি সংগ্রহ করেন। তবে যারা রুদ্রর কাছের মানুষ, তারা দাবী করেন, তীর্থক বা সিম্ফনি কেউই গানটির যথার্থ কথা জানতেন না। কারণ রুদ্র নিজেই কোথাও সম্পূর্ণ লিরিক গুছিয়ে যাননি। নাটকে আবার শঙ্কর সাওঁজাল গানটি করেন। মূলত নাটকের গানটি তারই কণ্ঠের।

পরবর্তীকালে ততকালীন পাঠকপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘আনন্দ বিচাত্রা’য় এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়। গানটির মূল কথা, তীর্থকের আর ‘সিম্ফনী’র গাওয়া কথা পাশাপাশি ছাপায়। আলোচনায় তীর্থকের করা গানটিকেই গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা হয়। সংখ্যাটি ছিল আনন্দ বিচিত্রা- সংখ্যা ১৪১, ১-১৫ অক্টোবর ১৯৯২।

কবিতা থেকে গান হয়ে আকাশসমান জনপ্রিয়তা পাবার পর ‘তোমাকে চাই’ ছবিতে গানটিকে ব্যবহার করা হয়। প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ এই গানে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালে।

এতো সব ইতিহাস, সবই কবির চলে যাবার পর। আবার তারই লেখা একটি কবিতার কিছু অংশ আবৃত্তি আকারে ১৯৯৪ সালে ব্যবহার করে ব্যান্ড ফিডব্যাক। অনেকের মতে এই ব্যান্ডটির সবচেয়ে জনপ্রিয় এ্যালবাম ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ যা প্রকাশিত হয় সাউন্ডটেকের ব্যানারে ক্যাসেটে। সেখানে ’মনে পড়ে তোমায়’ শিরোনামের গানে

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে।

অংশ টুকু জুড়ে দেওয়া হয়। গানটির মূল অংশ মাকসুদুল হকের লেখা ও গাওয়া। আর কবিতার অংশটি আবৃত্তি করেছেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়।

    আবার ফিডব্যাকের আরেকটি গানেও একই কবিতা শেষ লাইন , ‘এমনি করে সবাই যাবে, যেতে হবে…’ জুড়ে বাকীটুকু অন্যভাবে লিখতে দেখা গেছে। এছাড়াও তার জীবদ্দশায় আরও কিছু গান ছিল, যেমন,  ‘দিন গেল দিন গেলরে ও দিন গেলরে, মানব জমিন রইলো পতিত আবাদ করা আর হইলো না’, ‘ছিঁড়িতে না পারি দড়াদড়ি, খুলিতে না পারি দড়াদড়ি, সমাজের শেকলে আটকা পড়েছে পা রান্না ঘরে খুন্তি নাড়ানাড়ি’, ‘আমরা পাড়ি দেব রুদ্র সমুদ্র কালো রাত। আকাশে ভাসবে পাল ভালোবাসা, বাতাসে পাল ভালোবাসা’, ইত্যাদি।

    ১৯৮৫ সালে নারায়ণগঞ্জ টানবাজার পতিতা পল্লীতে শবমেহের নামের একজন কিশোরীকে জোর পতিতা বানাতে গিয়ে নির্মম অত্যাচারে মেরে ফেলে। শবমেহের নামের মেয়েটিকে নিয়ে ফকির আলমগীর একটি গানের ক্যাসেট বের করেন। সেখানে কবির চারটি গান ছিল। এই লাইন দিয়ে সেই সময় একটি আলোচিত পোস্টার করেছিল কয়েকজন তরুণ।

    ১৯৮৭ সালে প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসবে উৎসব সংগীত রচনার করেন রুদ্র। ‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা।’ সেটি সুর করেন ফকির আলমগীর। কণ্ঠ দেন ঋসিজ শিল্পী গোষ্ঠী। ১৯৮৮ সালে ফকির আলমগীর শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে একটি ক্যাসেট বের করেন। সেখানে রুদ্র একটি অসাধারণ গান রচনা করেন। ‘নূর হোসেনের রক্তে লেখা আন্দোলনের নাম। আমরা আবার নতুন করে সেই ভোরে জানলাম।’ গানটি সুর এবং কণ্ঠ দিয়েছেন ফকির আলমগীর।

    ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর পাঁচটি ক্যাসেটে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর বেশ কিছু গণসংগীত পরিবেশিত হয়। এছাড়াও রুদ্র মৃত্যুর পর তার লেখা এবং সুরারোপিত গান নিয়ে একটি অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়। যা হয়তো সংরক্ষণের অভাবে বিস্মৃত প্রায়। হতে পারে একারণেই মাত্র ৩৫ বছরব য়সে পৃথিবী ছাড়া অভিমানী কবির সকল প্রাপ্তি মৃত্যুর পরেই। তা যে পুরস্কারই হোক।

    রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রকৃতপক্ষেই প্রমাণ করেছেন, চলে যাওয়া মনে প্রস্থান নয়। তবে দাবীও রেখে গেছেন তার শব্দ সংরক্ষণের। কিভাবে? তার না থাকা জুড়ে থাকা শব্দ দিয়েই।

    লেখা: সৈয়দা ফারজানা জামান রুম্পা

    Share this article
    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Read next

    এবার ওটিটিতে ‘শরতের জবা’

    প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির দীর্ঘ দুই মাস পর এবার ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পেতে যাচ্ছে কুসুম সিকদার পরিচালিত…
    0
    Share