বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান গীতিকার জীবন। আসল নাম রবিউল ইসলাম। অসংখ্য জনপ্রিয় গান লিখেছেন তিনি। এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া ছয়টি সিনেমার পাঁচটিতেই রয়েছে তার লেখা গান। গত ঈদেও বেশ কিছু সিনেমার গান লিখেছেন তিনি। ২০২২ সালে গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পান জীবন।
জীবনের এই পথচলার শুরু বাবার রেডিও আর টেপরেকর্ডারের সাথে। শৈশবে ছড়ার মতো মিল করে কথা শুনাতেন তার মা। বাড়িতে কারও বিয়ে হলে অন্যদের সঙ্গে গীত গান গাইতেন। সেই থেকেই একটা ভালো লাগা তৈরি হয়েছে গানের প্রতি।
তবে বাবার মৃত্যু তাকে ভেঙ্গেচুরে দেয়। শৈশবেই মায়ের সঙ্গে সংসারের হাল ধরেন জীবন। পড়াশোনার পাশাপাশি বিড়ির ঠোঙা বানাতেন। টিউশনিও করতেন। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রকে পড়াতেন। মাইনে ছিল ত্রিশ টাকা। মায়ের চেষ্টা আর মামাদের ভালোবাসায় স্কুলের গণ্ডি পার করেন এই গীতিকার।
নোয়াখালীর প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষে চট্টগ্রামের সরকারি কমার্স কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়তে যান। সময়টা ২০০২ সাল। একদিন কলেজ থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে মাথায় হঠাৎ কয়েকটি লাইন ঘুরপাক খেতে থাকে। বাসায় গিয়ে লাইনগুলো কাগজে লিখে ফেলেন। লাইনগুলো মিলিয়ে গানের সাধারণ আঙ্গিকে তিনটি অংশ পূরণ করেন। এভাবে একে একে লিখে ফেলেন ৫০টি গান।
এই ৫০টি গান আর যৎসামান্য টাকা নিয়ে ২০০৪ সালে পাড়ি জমান ঢাকায়। পড়াশোনা করেন তিতুমীর কলেজে। কালক্রমে এক বন্ধুর মাধ্যমে ওয়ারফেজ ব্যান্ডের প্রধান ভোকাল পলাশের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেই পরিচয়ের সুবাদে জীবনের একটা গানের সুর করেন পলাশ।
২০০৩ সালেও কয়েকটি গান নিয়ে একবার ঢাকায় এসেছিলেন জীবন। সেবারই বেইলি রোডের একটি স্টুডিওতে সুরকার রাজেশ ঘোষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তার মাধ্যমেই ২০০৬ সালে আসিফ আকবরের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আসে জীবনের। তখন রোজার ঈদের অ্যালবামের প্রস্তুতি চলছে। জীবন জানতে পারেন, তার একটা লেখায় ভালো সুর হয়েছে, আসিফ আকবর ভয়েস দিলেই হয়ে যাবে। বন্ধুবান্ধব থেকে অনেককে সুখবরটি দেন। তবে সেই অ্যালবামে শেষ পর্যন্ত তার গান যায়নি! সেই স্মৃতি মনে করে জীবন বলেন, ‘মনে আছে সাত-আট দিন ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি, খেতে পারিনি। সেসময় একসঙ্গে অনেক অ্যালবামের কাজ চলত, ফলে এক ঈদের কাজ অন্য ঈদেও চলে যেত।’
দেখতে দেখতে কোরবানির ঈদও চলে এল। কয়েক দিনের জ্বর নিয়ে গ্রামে চলে যান রবিউল ইসলাম। ঈদের তখন দুই সপ্তাহ বাকি। এলাকার চা–দোকানের সামনে আড্ডা দিচ্ছেন। রাজেশের ফোন। জানতে পারেন, আসিফ আকবর তার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। ফোনের ওই প্রান্ত থেকে আসিফও তাকে শুভেচ্ছা জানান। উত্তেজনায় ঠিকঠাক ঘুম হলো না, পরদিন সকাল হতেই ঢাকায় চলে আসেন। ওই রোজার ঈদের পর সুরকার পল্লব স্যান্নালকেও চারটি গান দিয়েছিলেন জীবন। পল্লবও জানান, আসিফ আকবর তার গানে কণ্ঠ দেবেন!
২০০৭ সালের প্রথম দিন ছিল কোরবানির ঈদ। সেই ঈদকে সামনে রেখে আসিফ আকবরের ‘হৃদয়ে রক্তক্ষরণ’ অ্যালবামে স্থান পায় রবিউল ইসলামের লেখা ‘ভাড়াটিয়া চাই’ ও ‘ভালোবাসি বলে’ গান দুটি। তার ক্যারিয়ারের গতিপথ বদলে দেয় এই দুই গান। তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রাজেশ ও পল্লব স্যান্নালের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রবিউল ইসলাম বলেন, ‘এ দুজন না থাকলে হয়তো আজকের এ অবস্থান আমার হতো না। তাদের এই ঋণ কখনো শোধ হওয়ার নয়।’
২০০৮ সালে কিশোর দাশের ‘নিখোঁজ সংবাদ’ অ্যালবামের টাইটেল গানটি লেখেন। সুর করেন কুমার বিশ্বজিৎ। ২০০৮ থেকে টানা ২০১০ সাল পর্যন্ত পলাশের সুর ও সংগীতে কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশ পায়। এর মাঝে ‘ক্যানভাস’ অ্যালবামে জায়গা পায় চারটি গান। একটি গানে কণ্ঠ দেন ফাহমিদা নবী। এরপর পলাশের ‘প্রাচীর’ অ্যালবামে ৭টি গান জায়গা পায়। সাতটি গানে কণ্ঠ দেন শাফিন আহমেদ, পার্থ বড়ুয়া, মাহমুদুজ্জামান বাবু, ফাহমিদা নবী, রাফিয়াত রশিদ মিথিলা।
২০০৮ সালের ক্লোজআপ ওয়ানের মৌলিক রাউন্ডে যায়গা পায় জীবনের ‘আজ বৃষ্টির দিন’ গানটি। শওকত আলী ইমনের সংগীতায়োজনে অপুর কণ্ঠে গানটি দেশব্যাপী সাড়া ফেলে। অনুষ্ঠানের মঞ্চে রবিউল ইসলামও নিমন্ত্রণ পান। প্রথমবারের মতো টেলিভিশনে নিজেকে দেখতে পাওয়া। রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ইমন ভাইয়ের কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ। ক্লোজআপ ওয়ানের মতো মঞ্চে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল স্যারসহ সবাই গানটির অনেক প্রশংসা করেছিলেন।’
২০০৯ সালে প্রকাশ পায় তার লেখা গানে বেশ কয়েকটি অ্যালবাম, কাজের জন্য সম্মাননাও পান। এর মাঝে আসে বালাম ও জুলির অ্যালবাম ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, আসিফ আকবর-দিনাত জাহান মুন্নীর ‘ফিরব না আজ বাড়ি’। ‘বালাম ফিচারিং জুলি টু’ অ্যালবামের একটি গানের জন্য সিটিসেল–চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে শ্রেষ্ঠ গীতিকবির পুরস্কার জেতেন। পরের বছরও আরেকটি গানের জন্য একই অনুষ্ঠানে শ্রেষ্ঠ গীতিকবির পুরস্কার জেতেন।
২০১১ সালে দেশব্যাপী পরিচিতি এনে দেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে নিয়ে লেখা গান ‘জ্বলে ওঠো বাংলাদেশ’। দূরবীন ব্যান্ডের গাওয়া গানটি এখনো জনপ্রিয়। দেশের বিভিন্ন শিল্পী ছাড়াও ভারতের জুবিন নটিয়াল, পাপন, শুভমিতা, রূপঙ্কর বাগচী, রূপম ইসলাম, আকাশ সেন, ইমন চক্রবর্তীরা গেয়েছেন জীবনের লেখা গান।
জীবনের ত্রিশটি গান ইউটিউবে পার করছে কোটি ভিউর মাইলফলক। এর মধ্যে তাহসানের ‘কেউ না জানুক’, মিনারের ‘দেয়ালে দেয়ালে’, ইমরান ও পড়শীর ‘কথা একটাই’, ইমন খানের ‘ভুল মানুষের ঘর’, কাজী শুভর ‘বউ এনে দে’, ইলিয়াস ও অরিনের ‘না বলা কথা’, ইমরানের ‘নিশিরাতে চান্দের আলো’, ইমরান ও পড়শীর ‘জনম জনম’, রিজভী ওয়াহিদ ও শুভমিতার ‘চোখেরই পলকে’ উল্লেখযোগ্য। আর সিনেমার গানের মধ্যে কোটি পেরিয়েছে ইমরান ও কনার কণ্ঠে ‘কন্যা’, আকাশ সেনের ‘তোমাকে আপন করে’, ইমরানের ‘রাতভর’, আকাশ সেনের ‘আমার মতন কে আছে বলো’ ইত্যাদি।
চলতি বছর সাতটি সিনেমায় আটটি গান লিখেছেন জীবন। এর মাঝে ‘জ্বীন ৩’ সিনেমার ‘কন্যা’ গানটি বছরের অন্যতম জনপ্রিয় গান। চলতি ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া ছয়টি সিনেমার পাঁচটিতেই রয়েছে তার গান। ‘তাণ্ডব’-এ লিখেছেন ‘খবর দে’, ‘ইনসাফ’-এর টাইটেল গান ছাড়াও লিখেছেন ‘টগর’-এর ‘ও সুন্দরী’, ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’–এর ‘তোমাকে চাই’, ‘নীলচক্র’র ‘ধোকা’ গানগুলো।
সংগীতে স্বীকৃতি হিসেবে ২০২২ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান জীবন। রায়হান রাফী পরিচালিত ‘পরাণ’ সিনেমার ‘ধীরে ধীরে তোর স্বপ্নে’ গানটির জন্য এ পুরস্কার পান তিনি। জীবন বলেন, ‘মাকে নিয়ে পুরস্কারটি গ্রহণ করেছি। দিনটি এত আনন্দের, বর্ণনা করা যাবে না।’গান লেখার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করেন রবিউল ইসলাম। বর্তমানে একটি অনলাইন গণমাধ্যমের সহকারী বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন এই গীতিকার। তার স্ত্রীর নাম তাসনিমা আকতাব। এই দম্পতির ঘরে একমাত্র মেয়ে মাইজাহ ইসলাম রিদা।