‘মা লো মা ঝি লো ঝি‘। এই গানটি দিয়ে যেন সমালোচনার মেঘ কেটে সুরের আকাশে নতুন তারা জ্বলে উঠল। কোক স্টুডিও বাংলা সিজন থ্রিয়ের প্রথম গানটি নিয়ে আলোচনা সমালোচনার অন্ত না থাকলেও প্রীতম হাসানের প্রযোজনায় দ্বিতীয় গানটি সকলের মুখে মুখে ফিরছে।
আর সেই সাথে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছেন দুই ভাই, আরিফ দেওয়ান ও সাগর দেওয়ান। আরিফ দেওয়ান বড় ভাই, যিনি গানটি শুরু করেন, আর সবুজ পোশাক পরে সেই গানেই হাল ধরে সুরের স্রোতে টেনে নিয়ে গেছেন সাগর দেওয়ান।
নতুন ভাবে আলোচনাতে আসলেও সঙ্গীতের জগতে দেওয়ান পরিবার অনেকটা শক্ত খুঁটির মতন।
লোক সঙ্গীতের দুনিয়াতে তাদের ভাব, শব্দ এবং হেয়ালীতে সত্য তুলে ধরার যে ইতিহাস তারই একটি বহিঃপ্রকাশ সদ্য প্রকাশিত ‘মা লো মা’।
কোথা থেকে এলো এই দেওয়ান পরিবার?
এই পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি সুরের রাজ্যে অলিখিত রাজকুমার, তিনি এদেশের লোকসঙ্গীতের অন্যতম প্রতিভাধর শিল্পী ও সুর স্রষ্টা দেওয়ান আলেফ চাঁন শাহ ওরফে আলফু দেওয়ান।
খুব বেশি দূরে নয় রাজধানীর দক্ষিণ প্রান্তে বুড়িগঙ্গার ওপারেই কেরানীগঞ্জের বামনসুর আটি গ্রামে দেওয়ান আলেফ চাঁন শাহ ওরফে আলফু দেওয়ানের জন্ম । চারণ কবিদের মতো মঞ্চে দাঁড়িয়েই তিনি গান রচনা করতে পারতেন।
প্রায় হাজারটি আধ্যত্মিক গান তিনি রচনা করে গেছেন।
দেওয়ান আলেফ চাঁন শাহ ওরফে আলফু দেওয়ানের সুযোগ্য পুত্র দেওয়ান আবদুল মালেক ও দেওয়ান আবদুল খালেক।
বাংলাদেশের লোকগীতি ও বাউল সঙ্গীতের জগতে তার উত্তরসুরী হিসেবেই উজ্জ্বল নক্ষত্র যেন এই দুটি নাম। এছাড়াও এই দেওয়ান পরিবারের অনেকেই এখন রেডিও-টিভির নিয়মিত শিল্পী ।
বড় ছেলে দেওয়ান আবদুল মালেক মাত্র আঠারো বছর বয়স থেকে বাবার সুরে সুর মিলিয়ে গান শুরু করেন এবং নিজ প্রতিভা গুণে অচিরেই আধ্যাত্মিক গানে পটু হয়ে উঠেন ।
পরে ছোট ভাইও সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন ।
আলফু দেওয়ানের মৃ’ত্যুর পর দুই ভাই মিলে লোকগীতি, পালাগান, আধ্যাত্মিক, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদি, মারফতি, বাউল, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া প্রভৃতি গান গাইতে শুরু করেন।
তারাও মঞ্চে দাঁড়িয়েই তাৎক্ষণিক গান রচনা ও নতুন সুর সংযোজন করে সাথে সাথে গেয়ে যেতে থাকেন । এ রকম বহু নতুন ধারার লোকসঙ্গীত প্রবর্তন করেন যা এদেশের খুব কম সঙ্গীতশিল্পীই করতে সক্ষম হয়েছেন ।
দেওয়ান আবদুল মালেক বৃটিশ আমলে প্রথমে ঢাকা রেডিওতে গান করেন । পরে বড় ভাইয়ের সহায়তায় ও তার কাছে শিক্ষা লাভ করে ছোট ভাই আবদুল খালেকও রেডিওতে গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন । দু’ভাই মিলে ও শিষ্যদের নিয়ে তারা বহুবার রেডিওতে গান গেয়েছেন । ১৯৭৫ সালে তাদের বেশ কয়েকটি গানের রেকর্ড করা হয় । এদেশের গ্রামে-গঞ্জে কিংবা হাটে-বাজারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেই কেবল নয়, নগরীর সুধী সমাজেও তাদের গান আদৃত হয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে । দেওয়ান আবদুল মালেক ও দেওয়ান আবদুল খালেক প্রায় তিন হাজারেরও অধিক গান রচনা করেছেন ।
‘দেওয়ান গীতিকা’ নামে তাদের গানের বইও প্রকাশিত হয়েছে। ড. মনিরুজ্জামানের ‘ঢাকার লোককাহিনী” নামক গ্রন্থে দেওয়ান ভ্রাতৃদ্বয়ের অবদানের কথা কিছুটা লেখা রয়েছে ।
পালা গানের সম্রাট আবদুল মালেক ও খালেক দেওয়ানের পর খবির দেওয়ান, মাখন দেওয়ান, আরিফ দেওয়ান, কমল দেওয়ান, স্বপন দেওয়ান, কানন দেওয়ান, আজাদ দেওয়ান, শাকির দেওয়ান, কাঞ্চন দেওয়ান, উত্তম দেওয়ান, সজল দেওয়ান, সাবের উদ্দিন দেওয়ান, মুক্তি দেওয়ান, সুজন দেওয়ান, আকরাম দেওয়ানসহ অন্যান্য সদস্যের মাধ্যমে সগৌরবে পালাগান ও বাউল সঙ্গীতের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে।
সাধক খবির দেওয়ানেরই বড় ছেলে আরিফ দেওয়ান। যার সাধনা ও সঙ্গীত চর্চা নিয়ে জীবনীমূলক বই প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালের একুশে বইমেলায়। তারই ছোটভাই ঈষৎ কোকড়া চুলের সাগর দেওয়ান।
একটি সাক্ষাৎকারে সাগর দেওয়ান বলেছিলেন, ‘দেওয়ান পরিবারের সন্তান আমি। আমাদের পরিবারে সুফিবাদের চর্চা হয়ে আসছে প্রায় ২শ বছর ধরে। সুফিবাদ আর বাউলের যে মেলবন্ধন, তা খুব কাছে থেকে দেখেছি। চেষ্টা করছি এই ধারাতেই নিজেকে রাঙাতে।’
সতীর্থদের কাছেও তার কণ্ঠের মাদকতা পৌছে গেছে অনেক আগেই। মাল্টিমিডিয়ার যুগে নতুন করে আবারও তিনি ছুঁতে পারলেন আধ্যাত্মিক গানের ভক্তদের ’মা লো মা’ দিয়ে।
মরমী ঘরাণার এই শিল্পীরা বংশ পরম্পরায় সুরেই আছেন, গেয়ে যাচ্ছেন,
‘মানুষ একদিন মিশিবে মাটির সঙ্গে
ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে’।