জেমস! এই নামটির সাথে জমে আছে কত মানুষের বেড়ে উঠার গল্প। মাথা ঝাঁকানি বা আঙুল নাচানি। জেমস নামটি এখন আর কোনও ব্যক্তির নেই। এই নাম এক আবেগের। নব্বই দশকের বেড়ে উঠা থেকে শুরু করে আজ অবধি যে আবেগে ‘হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার’ ঘটে যায়, সেই আবেগ। যে আবেগে- ‘সব কথা কী খুলে বলা যায়?’ প্রশ্নটির উত্তর ইশারা হয়ে আসে সেই আবেগের নাম জেমস।
তার নাম মাহফুজ আনাম জেমস। ফিলিংস ব্যান্ডয়ের কোকড়া চুলের ছেলেটি এখন নগর বাউল ব্যান্ডের মূল নায়ক। পালিয়ে আসা বোহেমিয়ান গায়ক থেকে জেমস আজ সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক গায়ক, গিটারিস্ট। তার হাতের যাদুর ‘ঝাকানাকা’ মানেই অন্য কিছু।
অন্যদের বাবার মতই ‘গান’ করাকে ‘গুণ’ না ভাবা কড়া পিতার শাসন ছিল। তবুও সুরের টানে ঘর ছাড়েন জেমস। তাও কিশোর বয়সে। চট্টগ্রামের কদমতলীর পাঠানটুলী রোডের মতিয়ার পুলের আজিজ বোর্ডিং হয় তার ঠিকানা। এর ৩৬ নম্বর রুমটায় গান-বাজনা আর গিটারে দিনরাত কেটেছে জেমসের। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছিলেন, ‘আড্ডা আর গান যা-ই হোক না কেন, সব ওখানেই। আজিজ বোর্ডিংয়ের দিনগুলো কখনো ভুলব না।’ কারণ সে সময় ভাগ করে খাবার আর মেসের বিছানা। এই ছিল তার সম্পদ আর সুর ছিল তার শক্তি। যে শক্তির কারণেই চট্টগ্রামের ছেলে জেমস বন্ধু আর সমমনাদের নিয়ে তৈরি করেন ফিলিংস।
১৯৮৭ সালে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের সঙ্গে তার প্রথম অ্যালবাম ‘স্টেশন রোড’ মুক্তি পায়। ১৯৮৮ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘অনন্যা’।
অনন্যা ব্যান্ড জেমসকে নতুন করে রক দুনিয়াতে পরিচয় করিয়ে দেয়।
‘ভেবে ভেবে তোমার কথা উদাস হয়ে যাই..’ ‘একেজন বিবাগী’ গানের মাধ্যমে যেন রেট্রোলুক নিয়ে মেট্রোকে ঘায়েল করেন তিনি। যার আবহ চলে আসে, বলিউডের লাইফ ইন আ মেট্রো- সিনেমাতেও। বলিউডে করা তার ‘হামারি আধুরি কাহানি’ গানটি যেন আজও কত প্রেমিকের না পাওয়ার হাহাকার।
অনন্যা অ্যালবামের প্রসঙ্গ থেকে আসলে বের হয়ে আসাটা মুশকিল। কারণ ঐ যে আবেগের বশ, সেই বশ থেকেই শুরু হয় গুরু নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত মুখ জেমস।
তার গান মঞ্চে তিনি শুরু করেন বটে, কিন্তু শেষ করেন তার ভক্তরা। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও তার কনসার্টে ছিল না ভিন্ন রূপ। তারায় তারায় রটিয়ে দেব’, ‘মা’, ‘বাবা’, ‘বাংলাদেশ’, ‘জেল থেকে বলছি’, ‘কত কষ্টে আছি’, ‘বাংলার লাঠিয়াল’, ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’, ‘তুমি জানলে না’, ‘গুরু ঘর বানাইলা কী দিয়া’, ‘হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা’, ‘যেদিন বন্ধু চলে যাব’, ‘পথের বাপই বাপরে মনা’, ‘লেইস ফিতা লেইস’, ‘চিরটা কাল সঙ্গে রব’, ‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা’, ‘উঠেছে তুফান’, ‘সেলাই দিদিমণি’, ‘আমি তোমাদেরই লোক’, ‘নাগরালী’, ‘ফুল নেবে না অশ্রু’সহ অগণিত গান দিয়ে জেমস আছেন ভক্তদের ‘শিরায় শিরায়’।
যে আইয়ুব বাচ্চুর সাথে তার দ্বন্দ্ব নিয়ে মিডিয়া পাড়া ছিল সরব, তার প্রয়াণের দিন সংবাদ শুনে গিটার বাজাতে বাজাতে কাঁদতে দেখা গেছে জেমসকে। কারণ সম্পর্ক হয়তো তিনি মুখে বলতে পারেননি। বলেছেন, সুরে। লিখেছেন গিটারের তারে।
জেমসকে নিয়ে ভক্তদের আগ্রহের কমতি নেই। তবে জেমস নিজেও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টু শব্দটি করেননি বলেই হয়তো ভক্তরা সবার উপর স্থান দিয়েছেন তার সাধনাকে। রহস্য গল্পের নায়ক হয়ে শুধু মঞ্চেই নিজের গিটারকে অস্ত্র হিসেবে সমরে জয় করতে দেখা গেছে তাকে। এইখানেই একজন শিল্পীর সাফল্য।
এর মাঝে বাংলা সিনেমাতে প্লেব্যাক করলেও নিজের স্বকীয়তা ছেড়ে যাননি। সত্তা সিনেমার তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম- তারই প্রমাণ।
কনসার্টের মঞ্চে নিজেকে সরব রাখা এই রক লিজেন্ড ২০০৪ সালে কলকাতার সংগীত পরিচালক প্রীতমের সঙ্গে কাজ করেন। ২০০৫ সালে বলিউডের ‘গ্যাংস্টার’ সিনেমায় প্লেব্যাক করেন তিনি। ২০০৬ সালে আবারও বলিউড সিনেমা ‘চল চলে’ গানে কণ্ঠ দেন। ২০০৭ সালে তিনি ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’ সিনেমায় প্লেব্যাক করেন। তার প্রকাশ পাওয়া সবশেষ গান ‘সবই ভুল’। ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরের চাঁদ রাতে এটি প্রকাশ পায়। তাতে তার শ্রোতাপ্রিয়তার যে ‘তুফান’ তা কখনো থামেনি। বরং বেড়েই গেছে।
এজন্যই হয়তো জনপ্রিয়তার ভিসুভিয়াস এই শিল্পী তার একটি অ্যালবামের কভারে লেখেন-
‘আজ যদি আমি দেহ ত্যাগ করি,
নয় মাস পর আবার তোমাদের গর্ভে
জন্ম নেব, জন্ম নেব; জন্ম নেব …
মনে রেখো– আমার জন্মের কোনো শেষ নাই’..
ষাটের বছরে তাই ‘বালাই ষাট’ উপমহাদেশের প্রিয় কণ্ঠ জেমস। বলিউডের মহেশ ভাট যেমন বলেন, জেমসের মত ভয়েস আর নেই, বাংলাদেশের রকপ্রেমীরাও একই ভাবে প্রশ্ন করেন, ‘আমাদের জেমসের মত কে আছে?’
লেখা: সৈয়দা ফারজানা জামান রুম্পা