চলচ্চিত্র হলো এমন এক শিল্প, যা কিনা তৈরী হয়- স্টোরি, ক্যারেক্টার, মিউজিক, লাইটিং, ক্যামেরা, এডিটিং এবং কাস্টিং- এ সবগুলো বিষয়ের সমন্বয়ে। আর এই চলচ্চিত্রশিল্পকে স্বীকৃতি দেয়া অন্যতম বড় প্রদর্শনীর নাম- কান চলচ্চিত্র উৎসব। সম্প্রতি ফ্রান্সের কান শহরে পর্দা নামলো বিশ্বের অন্যতম এই প্রভাবশালী উৎসবের ৭৭তম আসরের। ১৪ মে উদ্বোধনের পর থেকে ২৫ মে পুরস্কার বিতরণের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ১২ দিনের এই আয়োজন।
‘সোফি’স চয়েজ’ খ্যাত অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপের সম্মানসূচক স্বর্ণপাম পাওয়া হোক, বাংলাদেশি অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনার মায়ের বিয়ের শাড়িতে কান উৎসব মাতানোর ব্যাপার হোক, ১৭ বছর পর এই আসরে হাজির হয়ে বলিউডের অভিনেত্রী প্রীতি জিনতার দ্যুতি ছড়ানোই হোক, কিংবা লাল গালিচায় কুকুর মেসির পোজ দেয়ার বিষয়টিই হোক না কেন—সব মিলিয়ে জমজমাট ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৭ তম আসর।
বিশ্বের সকল সিনেমাপ্রেমীদের মুখে মুখে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের নামটি বিচরণ করলেও এই আয়োজন নিয়ে রয়ে গেছে অনেক কিছুই অজানা। আপনি জানেন কি, চাইলে যে কেউই চলচ্চিত্র জমা দিতে পারেন কানে? তাছাড়া কখনো খেয়াল করে দেখেছেন কি উৎসবটি সব সময় ১২দিনেরই হয়? কোথা থেকে শুরু হলো কান চলচ্চিত্র উৎসব?
চলচ্চিত্রশিল্পকে স্বীকৃতি দেয়ার আইডিয়াটি প্রথম আসে বিখ্যাত লেখক ফিলিপ্পে এরল্যাঙ্গার কাছ থেকে। সালটা ছিল ১৯৩৮।
১৯৩৮ সালে লেখক ফিলিপ্পে এরল্যাঙ্গার কান উৎসব আয়োজনের ধারণা দেয়ার পর কান চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম আসর বসার কথা ছিল ঠিক তার পরের বছর। অর্থাৎ, ১৯৩৯ সালে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। যুদ্ধের পরিবেশ পেরিয়ে এরপর প্রথম আসর বসেছিল ১৯৪৬ সালে। যা আয়োজন করা হয় ক্ষুদ্র পরিসরে। আর আসরের সেরা পুরস্কার ‘পাম ডি’অর’ বা ‘স্বর্ণপাম’ প্রথম প্রদান করা হয় ১৯৫৫ সালে। পরবর্তীকালে ১৯৯৭ সালে পুরস্কারটির আধুনিকীকরণ করে ২৪ ক্যারেটের সোনা ও ক্রিস্টাল বসায় সুইস জুয়েলারি কোম্পানি চোপার্ড।
১৯৪৬ সালে শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতি বছরের মে মাসে ভূমধ্যসাগরের উপকূলে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের শহর কানে ১২ দিনের জন্য বসে এ আসর। প্রতিবছর সেরা চলচ্চিত্রকে পুরস্কৃত করা হয়। উৎসবটি পরিণত হয়েছে বিশ্বের চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনয়শিল্পী ও প্রযোজকদের অন্যতম একটি মিলনমেলা হিসেবে। স্বর্ণপাম পুরস্কারের জন্য এটি বিশেষভাবে পরিচিত হয়েছে, যা আসরের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে সেরা চলচ্চিত্রকে দেয়া হয়। প্যালেস অব ফেস্টিভ্যালে বসে প্রতিযোগিতা বিভাগের আসর।
প্রতিবছর উৎসবে দেখানোর জন্য প্রায় দুই হাজার সিনেমা জমা পড়ে। সিলেকশন কমিটি প্রতিটি সিনেমা দেখার পর সেখান থেকে ৫৬টি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ও ১৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা অফিশিয়াল সিলেকশনের জন্য নির্বাচন করে। কানের মূল আসরে মূলত প্রদর্শন করানো হয় এই ৭০টি সিনেমাই।
নির্বাচিত সিনেমাগুলোকে ভাগ করা হয় বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরিতে। এই ক্যাটাগরিগুলো হলো-
১. কম্পিটিশিন: ফিচার ফিল্মস অ্যান্ড শর্টফিল্মস
২. ফিচার ফিল্মস আউট অব কম্পিটিশন
৩. আঁ সার্ত্রে রিগা
৪. সিনেফনডেশন
মূল প্রতিযোগিতা কিংবা অন্যান্য ক্যাটাগরিতে সিনেমা সিলেকশনের জন্য কয়েকটি বাধ্যতামূলক নিয়ম মেনে চলতে হয়- কানে প্রদর্শিত হতে হলে সিনেমা অবশ্যই উৎসবে জমা দেওয়ার অন্তত ১২ মাসের মধ্যে নির্মিত হতে হবে। এখানে প্রদর্শনের পূর্বে সেই সিনেমাটি কোনো আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে, এমনকি যে দেশে তৈরি হচ্ছে, সেই দেশেও প্রদর্শন করানো যাবে না। পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকলেও স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ১৫ মিনিটের বেশি হতে পারবে না।
এদিকে পুরস্কার প্রদানের জন্য কানের অফিশিয়াল জুরি দুই ভাগে বিভক্ত—দ্য ফিচার ফিল্মস জুরি ও দ্য শর্টফিল্মস অ্যান্ড সিনেফনডেশন জুরি। গোপন ব্যালটে ভোটগ্রহণের পর এই উৎসবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিয়ম অনুসরণ করা হয়। জুরি সদস্য যারা থাকেন, প্রতিযোগিতায় তাদের কোনো সিনেমা থাকতে পারে না। জুরির জন্য সদস্যদের নির্বাচন করা হয় সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে।
কানের জুরি হওয়ার সম্মান আছে বাংলাদেশের কাছেও। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জুরি হিসেবে রেড কার্পেটে হেঁটেছিলেন বিধান রিবেরু।
চলচ্চিত্র সমালোচক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক বিধান রিবেরু প্রথমবারের মতো কান চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি সদস্য হওয়ার সম্মান বয়ে এনেছিলেন কানের ৭৫তম আসরে।
এদিকে ২০২৪ সালে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র সমালোচক ও চিত্রনাট্যকার সাদিয়া খালিদ রীতি ফিপ্রেসকি (ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিকস) জুরি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন। এর আগেও তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সালটা ছিল ২০১৯।
তাছাড়া ২০০২ সালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সমালোচক আহমেদ মুজতবা জামাল ফিপরেস্কির বিচারক ছিলেন। ২০০৫ ও ২০০৯ সালে তাকে আরও দুবার ফিপরেস্কির বিচারকের আসনে দেখা গেছে।
এবার আসা যাক কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশি সিনেমার জায়গা করে নেয়ার প্রসঙ্গে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশি সিনেমাও প্রদর্শিত হয়ে আসছে চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সম্মানজনক এই উৎসবে।
২০০২ সালে বাংলাদেশের কালজয়ী পরিচালক তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ বাংলাদেশ থেকে কানে অংশ নেয়। ছবিটি ফিপরেস্কিতে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কারও পায়।
এরপর ২০১৬ সালে কান ক্লাসিকস বিভাগে খান আতাউর রহমানের উর্দু ছবি ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ প্রদর্শিত হয়। ১৯৫৮ নির্মিত সিনেমাটি বাংলাদেশে চিত্রায়িত হয়েছিল।
২০২১ সালে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ পরিচালিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ জায়গা করে নেয় আঁ সার্ত্রে রিগা বিভাগে। আজমেরী হক বাঁধন অভিনীত এই সিনেমাই ছিল কানের কোনো প্রতিযোগিতা বিভাগে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সিনেমার জায়গা পাওয়ার ঘটনা।
এছাড়াও ২০২২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের বাণিজ্যিক শাখা মার্শে দ্যু ফিল্মে ভারতীয় প্যাভিলিয়নে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমাটির ট্রেলার প্রদর্শিত হয়েছিল।
ফিরে আসা যাক ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে। এবারের আয়োজনে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে সর্বোচ্চ পুরস্কার স্বর্ণপাম জিতেছে মার্কিন নির্মাতা শন বেকারের সিনেমা ‘আনোরা’। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার গ্রাঁ প্রিঁ জিতেছে পায়েল কাপাডিয়ার ‘অল উই ইমাজিন অ্যাস লাইট’। ২০২৮ সালের কান উৎসবে ছিল আরও কিছু চমক।
৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন আসরের আলোচিত সিনেমা ‘এমিলিয়া পেরেজ’-এর চার অভিনেত্রী- অ্যাড্রিয়ানা পাজ, যোয়ি সালদানা, সেলেনা গোমেজ ও ক্লারা সোফিয়া গ্যাসকন। সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন স্বর্ণপামজয়ী ফরাসি পরিচালক জ্যাক অডিয়াঁর।
এদিকে ‘কাইন্ডস অব কাইন্ডনেস’ সিনেমায় অভিনয় করে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন মার্কিন অভিনেতা জেসি প্লেমনস।
কোরালি ফারজাঁ জয় করেছেন সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার। তাছাড়াও আলোচিত ইরানি নির্মাতা মোহাম্মদ রাসুলফ তার ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’ সিনেমার জন্য বিশেষ পুরস্কার পেয়েছেন।
সবশেষে জানানো যাক, চিত্রালীর নজরে ২০২৪ সালের কান উৎসবের হাইলাইটেড কয়েকটি মুহূর্ত।
- এবার প্রতিযোগিতা বিভাগে আঁ সার্তে রিগায় সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন কলকাতার অভিনেত্রী অনসূয়া সেনগুপ্ত। কনস্ট্যানটিন বোঁজ্যনভের ‘দ্য শেমলেস’ চলচ্চিতের জন্য এ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
- বলা বাহুল্য, ৭৭ তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে নিজের ডিজাইন করা পোশাকে নিজেই রেড কার্পেট আলো করে ফ্যাশন দুনিয়ায় আলোচনার তুঙ্গে উঠে এসেছে ফ্যাশ্ন ইনফ্লুয়েন্সার ন্যান্সি ত্যাগী।
- পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনকেও দেখা গেছে এবারের আসরে। না না, ভয়ের কোনও কারণ নেই। মূলত ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ সিনেমার প্রদর্শনীতে লালগালিচায় প্রয়াত এ পপ তারকার সাজে হাজির হয়েছিল এক ব্যক্তি। মুহূর্তেই সংবাদের শিরোনামে পরিণত হন তিনি।
- এছাড়াও ফিলিস্তিনের পতাকার রঙে কানের লাল গালিচায় দেখা গেছে অস্কারজয়ী অস্ট্রেলিয়ান হলিউড অভিনেত্রী কেট ব্লানচেটকে। এর মাধ্যমে ফ্যাশন–মুহূর্ত তৈরির পাশাপাশি কান উৎসবেও তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন ফি’লি’স্তিনের কথা।
বসতে থাকুক কানের জমজমাট সব আসর। বিনোদন অঙ্গন মুখোরিত হোক একের পর এক তাক লাগানো চলচ্চিত্র নিয়ে, যেন চিত্রালীও চলে আসতে পারে আবারও কানের অন্য আসরের খবর নিয়ে।
লেখা: রাহনামা হক